মেহেদী হাসান

  ০৫ এপ্রিল, ২০২৪

মশা মারতে ব্যর্থ হাঁস-ব্যাঙ-মাছ

ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা তো আছেই, গরমের শুরুতেই কিউলেক্স মশার কামড়েও অতিষ্ঠ নগরবাসী। শুধু রাতে নয়, দিনেও মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া দায়। মশার লার্ভা নিধনে ঢাকার ঝিল, লেক ও পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির কয়েক হাজার হাঁস ছাড়া হয়। এর আগে ব্যাঙের পোনা, গাপ্পি ও তেলাপিয়া মাছও ছাড়া হয়েছিল

মশকনিধনে। এখন ৯০ শতাংশ হাঁস গায়েব, দূষিত পানিতে মরে সাফ হয়েছে গাপ্পি, জানা যায়নি তেলাপিয়া মাছের প্রজনন সম্পর্কে। এসব উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব হাস্যকর, আজগুবি ও অবৈজ্ঞানিক প্রকল্প দিয়ে মশকনিধন সম্ভব নয়। রাজধানীর মশা নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে শুধু ঢাকায়ই মশা বেড়েছে দ্বিগুণ। মশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খরচ বেড়েছে দুই সিটি করপোরেশনেরও।

তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মশকনিধনের বাজেট ধরা হয়েছে ১৫২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ১২১ কোটি ৮৪ লাখ এবং দক্ষিণ সিটিতে ৩১ কোটি ১ লাখ টাকা। অন্যদিকে মশকনিধনে গত ১২ বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করেছে দুই সিটি। এ বিপুল অর্থে মশকনিধনের নানা যন্ত্রপাতি, কীটনাশকসহ কেনা হয়েছে মাছ, ব্যাঙ, হাঁস ও ব্যাকটেরিয়া। ঢাকা দক্ষিণের ১০ অঞ্চলে ৭৫টি ওয়ার্ডে মশকনিধনে জনবল রয়েছে ১ হাজার ৫০ জন। তাদের মধ্যে ১৫০ জন মশক সুপারভাইজার। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০ অঞ্চলের ৫৪ ওয়ার্ডে ৭৫ মশক সুপারভাইজারসহ জনবল ৬০০ জন।

মশকনিধনে ভুল পথেই হাঁটছে দুই সিটি : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে ফগার মেশিন দিয়ে মশা তাড়ানোর সনাতন পদ্ধতিকে ভুল বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এতদিন ভুল পদ্ধতিতে মশকনিধন কার্যক্রম চালানো হয়েছে। অথচ এখনো সেই ভুল পথেই হাঁটছে ডিএনসিসিসহ দেশে মশকনিধনের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো। উপরন্তু মশকনিধনে হাঁস, মাছ, ব্যাঙের মতো আজগুবি প্রকল্পে অর্থ নষ্ট করেছে দুই সিটি। দিনরাত ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটালেও মশকনিধন সম্ভব নয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, মশাকে গুরুত্ব দিলে এতদিনে কার্যকর পদ্ধতিতেই মশকনিধন সম্ভব। শুধু ওষুধ ছিটিয়েই মশা ধ্বংস করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা ও সচেতনতা। নগর এবং অঞ্চল পরিকল্পনায় পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি আনতে হবে আগে। কেননা প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে মশা বংশবৃদ্ধি করতে পারবে না। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘পরিকল্পিত ও পরিচ্ছন্ন শহরে মশা কম হবে। সবার আগে পরিকল্পিত ও পরিচ্ছন্ন নগর গড়ার দিকে জোর দিতে হবে। সরকার সামগ্রিকভাবে জলাশয়, ডোবা, লেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে যতটা না জোর দিচ্ছে, তার চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে ওষুধ কেনার দিকে। শতকোটি টাকার বাজেটে এ কারণেই মশা কমছে না।’

হাঁস-ব্যাঙের আজগুবি প্রকল্প : মশকনিধনে হাঁস, মাছ, ব্যাঙের মতো আজগুবি প্রকল্পও নিয়েছিল দুই সিটি কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর হাতিরঝিলসহ ঢাকার বিভিন্ন লেক ও পুকুরে হাঁস ছাড়া হয়েছিল। তবে বছর না ঘুরতেই হাতিরঝিলসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ওই হাঁসের দেখা মেলেনি। এলাকাবাসী বলছেন, সরকারি জিনিস যে যেভাবে পেয়েছে, খেয়েছে। আবার মারা গেছে কিছু হাঁস। মশা মারতে এমন উদ্ভট কৌশল অবাস্তব বলেও জানান তারা। রমনা পার্কের লেকে মশা মারতে ২০২১ সালে ছাড়া হয় ৭৫টি হাঁস। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এমন ১০টি জলাশয়, পুকুর ও খালে ছাড়া হয় পাঁচ শতাধিক হাঁস, ৫ মণ তেলাপিয়া মাছের পোনা ও ১০ হাজার ব্যাঙাচি। মহানগর নাট্যমঞ্চের পুকুরে গত বছর মার্চে ছাড়া হয় ৭০টি হাঁস। পরে রান্না করে খেয়ে ফেলা হয়েছে সেই হাঁস। এখানকার দুটি চৌবাচ্চায় ছাড়া হয়েছিল কয়েক কেজি তেলাপিয়া মাছ আর ব্যাঙাচি। কিটতত্ত্ববিদরা বলছেন, কিউলেক্স মশার লার্ভা হাঁসের খাদ্য না। হাঁস দিয়ে মশা কখনোই নিধন করা যায়নি, এখনো যাচ্ছে না এবং ভবিষ্যতেও যাবে না। ফলে এসব প্রকল্পে ব্যয় হলেও সুফল মেলেনি জনগণের।

ঢাকায় ৯০ শতাংশ কিউলেক্স মশা : মশা নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন মশকনিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সিটি করপোরেশনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে একই বৈঠকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ঢাকার খাল পরিষ্কারের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের নয়। খালগুলো পরিষ্কারের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউক খাল পরিষ্কার না করার কারণেই মশা ভয়ানকভাবে বাড়ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশারের নেতৃত্বে ঢাকায় মশার ঘনত্ব, মশার প্রজাতি এবং মৌসুম অনুযায়ী মশার ধরন নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হয়ে আসছে।

এ গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার দক্ষিণখান, উত্তরা, মিরপুর, সাভার ও যাত্রাবাড়ী এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মশা রয়েছে রাজধানীর উত্তরা ও দক্ষিণখানে। মশার এ দুটি রাজত্বই পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে। গত বছরের নভেম্বরে যেখানে ঘনত্ব ছিল ২০০টি। সেখানে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বেড়ে হয় ৩০০টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩৮৮টি এবং মার্চ মাসে প্রতিটি ফাঁদে ধরা পড়া মশার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪২০টি। এসব মশার ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা। বাকি ১ শতাংশের মধ্যে এইডিস, অ্যানোফিলিস, আর্মিজেরিস ও ম্যানসোনিয়া মশা রয়েছে। তবে ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগের জন্য কিউলেক্স মশা দায়ী, এটি প্রাণঘাতী নয়। তবে এ মশা মানুষকে প্রচুর কামড়ায়, বিরক্তির উদ্রেক করে। কামড়ালে ত্বকে লাল দাগ পড়ে, কামড়ের স্থানে চুলকায়।

মশার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ড. কবিরুল বাশার বলেন, শীতকালে যখন বৃষ্টি থাকে না, তখন ড্রেন, ডোবা নর্দমার পানি ঘন হয়ে পানিতে জৈব উপাদান বেড়ে যায়। এ সময় কিউলেক্স মশার প্রচুর প্রজনন ঘটে; যে কারণে এ সময় মশা বেড়ে গেছে। কিউলেক্স মশার ঘনত্ব এখন ৯৫ শতাংশের বেশি। এটা এখন সর্বোচ্চ অবস্থায় আছে। এটা অনেক ভয়ংকর অবস্থা। আপনি কোথাও দাঁড়াতে পারবেন না, মশা এমন যন্ত্রণা করবে। মশকনিধনে সিটি করপোরেশনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। ওইসব জায়গা পরিষ্কার করে লার্ভিসাইডিং করতে হবে। আর বৃষ্টিপাত শুরু হলে মশার উপদ্রব কিছুটা কমবে।

দেশে মশা মারার প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম ধোঁয়া দেওয়া, যা ফগিং নামে পরিচিত। যদিও এটি মশা মারার ভুল পদ্ধতি বলছেন স্বয়ং ডিএনসিসি মেয়র। এ পদ্ধতিতে উড়ন্ত মশা মারতে ধোঁয়ার মাধ্যমে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটিও এ পদ্ধতি ব্যবহার করে। আমদানি করা ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি ৫শতাংশ হারে ডিজেলের সঙ্গে মেশানো হয়। পরে ফগার যন্ত্রের সাহায্যে ধোঁয়া হিসেবে ওই মিশ্রণ প্রয়োগ করা হয়। তবে ম্যালাথিয়নে মশা মরে কি না, তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ম্যালাথিয়ন ও ডিজেলের মিশ্রণ প্রয়োগ করছিলেন মশক কর্মী খোকন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিকেলে ১০ জন মশক কর্মী বের হয়েছি। ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া দিচ্ছি। ভেতরে কি কি আছে জানি না। আমাদের ধোঁয়া দিতে বলা হয়েছে তাই দিচ্ছি।

এদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে দুই সিটি করপোরেশনের নিজস্ব জরিপ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদরা। কিন্তু এখনো দুই সিটির এমন সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। মশার ঘনত্ব কোথায়, কী অবস্থায় আছে, তা জানতে দুই সিটি ভরসা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার বছরজুড়ে চলা তিন জরিপের ওপর। এ তিন জরিপ হয় প্রাক বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষার পর। গত কয়েকদিন রাজধানীতে যে বৃষ্টি হয়েছে, তাতে দ্রুত এ দুই সিটির মশা পরিস্থিতির জরিপ দরকার ছিল বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদরা। তারা বলছেন, এখন যদি বোঝা যেত মশা কতটা বাড়ল, তাহলে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারত দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু তাদের সেই সক্ষমতা নেই। তাই যখন পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, তখন তারা কাজ শুরু করবে। এর আগে মশকনিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ভেজাল কোম্পানির কাছ থেকে কীটনাশক ‘বিটিআই’ আমদানি করায় ওই সিটির মশা মারার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। তবে সারা দেশের সিটি করপোরেশন মশা মারতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবীর প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে আছে। যেসব মশার উপদ্রব দেখা যাচ্ছে অধিকাংশই কিউলেক্স মশা। এখনো ডেঙ্গু মৌসুম আসেনি, সামনে ডেঙ্গুর মৌসুম। তাই আগাম খাল, বিল, ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে। মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সকাল-বিকেলে ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে।’ ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মীর খায়রুল আলম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘প্রথমত, আমরা জনগণকে সচেতন করার কাজ করছি; দ্বিতীয়ত, মশার বংশবৃদ্ধি রোধে খাল, লেক, পুকুর পরিষ্কার করা হচ্ছে এবং তৃতীয়ত, মশা মারার জন্য সকাল-বিকেল ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। জনগণকে সচেতন করতে না পারলে মশা কমানো সম্ভব নয়। আমরা খাল-লেক পরিষ্কার কারছি আর জনগণ নোংরা করছে। সবার আগে জনগণকে সচেতন হতে হবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close