গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৯ মার্চ, ২০২৪

লাগামহীন ওষুধের দাম ক্রেতার নাভিশ্বাস

নিত্যপণ্যের মতো আইনি মারপ্যাঁচে লাগামহীন ওষুধের বাজারও। নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের মাসিক ওষুধের খরচ সমন্বয় করতে রীতিমতো হিমশিম অবস্থা। কিন্তু টনক নড়ছে না ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। ৩০ বছর আগের গেজেট বহাল থাকায় ওষুধ উৎপাদনকারী সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। কারণ গেজেটেই নির্ধারিত আছে ১১৭টি জেনেরিক ওষুধের বাইরে দাম বাড়লে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়টি। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের দামে লাগাম টানতে হলে গেজেটে সংশোধনী আনতে হবে আগে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রাণসংহারী করোনার পর ওষুধের বাজার লাগামহীন হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে হার্টের, ব্যথার (অ্যান্টিবায়োটিক) প্রেসারের, গ্যাসের এবং প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ যা জ্বর, সর্দি-কাশিসহ তাৎক্ষণিক অসুস্থতায় মানুষ খেয়ে থাকে। রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, মিরপুর, শাহবাগ, পুরানা পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় ফার্মেসি ঘুরে বাজারদর যাচাই করে প্রকারভেদে দুই থেকে ১৫ টাকা বৃদ্ধির সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে। দোকানিরা ওষুধের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ডলারের দাম বৃদ্ধির কথা জানান।

রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালেও অগণিত চিকিৎসাপ্রার্থীর সঙ্গে কথা হয় ওষুধের দাম নিয়ে। তারা বিষয়টি নিয়ে তাদের ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানান। শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে কথা হয় নারায়ণগঞ্জের মদনপুরের বাসিন্দা রাসেল ভুঁইয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, সংসার ও দুই সন্তানকে পড়াশোনা করাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তার ওপর প্রতিনিয়ত আমার ওষুধের জন্য অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। যে টাকা আয় করছি, তা দিয়েই তো চলতে হয় আমাদের।

শাহীন নামের আরেকজন বলেন, আমার আব্বার কিডনিতে সমস্যা, চোখে দেখতে পায় না, প্রেসার ও হার্টেরও সমস্যা আছে। বছরের পর বছর ধরে চিকিৎসা নিতে হয়। ওষুধের দাম বাড়ায় আমাদের হিমশিম অবস্থা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক বছর আগে যে সিরাপ বিক্রি হয়েছে (নাপা-সিরাপ) ২০ টাকায়, তা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। মানুষ সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় ভোগে গ্যাসের সমস্যায়। এই ওষুধের প্রতিটির দাম বেড়েছে ১ টাকা। সেকলো-২০ এমজি প্রতিটি ৫ টাকার পরিবর্তে বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকায় এবং সারজেল-৪০এমজি ১০ টাকার ওষুধ ১ টাকা বেড়ে ১১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার কার্ডিয়াক ডিজিজের বিশেষ করে প্রেসারের ওষুধ প্রতিটির বেড়েছে ২ টাকা। এর মধ্যে ওসাটিল ও এনজেলিক ওষুধ রয়েছে। আবার ব্যথার ওষুধ নেপক্সিন গ্রুপের নেপোএপ্লাস প্রতিটির দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। এছাড়া ক্লাভসেভ ও সেভোটিল প্রতিটিতে বেড়েছে ১৫ টাকা। ফলে এক বছর আগে ৪৫ টাকায় কেনা গেলেও এখন কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকায়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি কোম্পানি মোট ওষুধের শতকরা ৪৫ শতাংশ উৎপাদন করে। এগুলো হলো- স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, গ্লাক্সো, রেনেটা, ইনসেপটা, হেলথ কেয়ার, এসকেএফ, সেনডোজ ও ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দুই বাজারেই বাংলাদেশি ওষুধের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

২০১৪ সালে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা, বর্তমানে তা প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রতি বছর ওষুধের বাজার বেড়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি।

ওষুধ সমিতির তথ্যমতে, সারা দেশে প্রায় ৩ লাখ ওষুধের দোকান রয়েছে। ঢাকার মিটফোর্ড ছাড়াও খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে আরো পাঁচটি বড় ওষুধের মার্কেট রয়েছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও মুখপাত্র (সদ্য পিআরএল কর্মকর্তা) ডা. মো নুরুল আলম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ইচ্ছেমতো ওষুধের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আইনের কিছুটা জটিলতা রয়েছে। সরকার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ১১৭টি জেনেরিক ওষুধের। বাকি ২৫ হাজার সরকার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য ওষুধ তাদের উৎপাদন খরচসহ নানা অনুষঙ্গিক যোগ করে বাজারজাত করে। আর দায়সারাভাবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সরকারকে ভ্যাট প্রদানের মাধ্যমে মূল্যের বৈধতা দিয়ে থাকে। ফলে ওই সব ওষুধের ওপর সরকারের বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা।

এই কর্মকর্তা বলেন, ভ্যাট প্রদানের মাধ্যমে যেসব ওষুধ সরকারের তদারকির সুযোগ আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও আবার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের খোঁড়া যুক্তি আছে। তার মধ্যে অন্যতম ডলার, ওষুধের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং যোগাযোগ খরচ বেড়ে যাওয়া।

ডা. মো. নুরুল আলম জানান, সরকার যে ১১৭টি ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা রাখে, সেই গেজেটটি ১৯৯৪ সালের। এটি ১১৭টি না হয়ে ১১ হাজার ওষুধের জেনেরিক হলে তো সমস্যা নেই। বলা যায়, শস্যের মধ্যে ভূত রয়েছে। যারা ওষুধ উৎপাদন করেন তারাও ব্যবসা করুক। আমরা তাদের ব্যবসা করতে নিরুৎসাহিত করছি না। তবে ব্যবসা করতে হবে মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে। এজন্য ৩০ বছর আগের গেজেট সংশোধন করা গেলে ওষুধের দামও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করি।

তবে ভিন্নমত পোষণ করেছেন ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিউজ্জামান। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ওষুধের দাম যেভাবে বাড়ার কথা সেভাবে বাড়েনি। কারণ আগে ডলার ৮০-৮২ টাকা ছিল সেটি বেড়ে ১৩০ টাকা হয়েছে। এইখানেই বড় গ্যাপ তৈরি হয়েছে। ওষুধের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনতে হয়। এগুলোর দাম বেড়েছে। প্রতি পিস ওষুধের দাম ১০ টাকা বেড়েছে, এটাকে আপনি অস্বাভাবিক মনে করছেন কি না, জবাবে বলেন, ‘না’। এখনো কমই আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসার ডা. মোজাহেরুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ওষুধের দাম বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে যদি কাঁচামালের দাম বেড়ে যায় ও শুল্ক যদি বেশি বসায় তাহলে দাম বাড়তে পারে। কিন্তু সরকার যাদের ওষুধ আমদানির লাইসেন্স দিয়েছে তাদের প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যয় খুবই সামান্য। সুতরাং ওষুধের দাম স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। এজন্য দুটি কাজ করতে হবে, একটি বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কার্যকর করা এবং আগের আইন বদলে ফেলা। পাশাপাশি নীতিমালা ঠিক করতে হবে। তারা কখন কী কারণে দাম বাড়াবে সেটা জানাতে হবে এবং বাড়ালে সরকারের অনুমতি নিতে হবে- এমন নীতিমালা করতে হবে। তাহলে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াতে পারবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close