মেহেদী হাসান

  ২৮ মার্চ, ২০২৪

ভুল পরিকল্পনায় ঢাকায় যানজট

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে কাঁটাবনে এক ইফতার আয়োজনে যোগ দিতে গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রওনা দেন হাসান আলী। তিনি ইফতারে যোগ দিতে পেরেছিলেন ৬টা ৮ মিনিটে। মাত্র সাড়ে ৩ কিলোমিটার পথ যেতে ১ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট লাগায় ক্ষোভ ঝাড়েন হাসান। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, রাজধানীতে প্রতি ২ ঘণ্টার যাত্রাপথে ৪৬ মিনিটই নষ্ট হয় যানজটে। এভাবে বছরে গড়ে ২৭৬ ঘণ্টা নষ্ট হয়। নষ্ট হয় কর্মঘণ্টা। কমে যায় শ্রমের মান।

রাজধানীতে রমজানে দুপুর সাড়ে ৩টায় অফিস ছুটির পর ইফতারের আগ পর্যন্ত নগরীর প্রতিটি সড়কে তীব্র যানজট দৃশ্যমান। একই সময়ে সব যানবাহন গন্তব্যে রওনা দেওয়ায় নগরীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে অযাচিত যানজট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছে ট্রাফিক বিভাগ। দপ্তরটি যানজট নিরসনে বেশ কয়েকটি বিশেষ নির্দেশনাও দিয়েছে। তবে কাজে আসেনি কোনো নির্দেশনা। উল্টো বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় রমজানে তীব্র যানজটে মানুষের ক্ষোভ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে ঢাকার রাস্তা : যানজট নিরসনে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় দৈনিক গড়ে ৩ কোটি ট্রিপ বা লোক চলাচল ছিল (একজন লোক যতবার চলাচল করে, ততটা ট্রিপ তৈরি হয়)। ২০২৫ সালে ৪ কোটি এবং ২০৩৫ সালে ৫ কোটির বেশি ট্রিপ তৈরি হবে। এর বাইরেও আছে পণ্য পরিবহন। বিষয়টি বুঝতে পেরে সরকার এখন ঢাকার মাটির নিচের ২৫ থেকে ৭০ ফুট গভীরে গিয়ে ৪০ লাখ যাত্রীর পারাপার সক্ষমতার ১১টি সাবওয়ে নির্মাণের কথা ভাবছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবহার করেন ৫৩ শতাংশ যাত্রী আর মাত্র ১১ শতাংশ যাত্রী ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত গাড়ি। অথচ ঢাকার ৭০ শতাংশ রাস্তা ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশার দখলে থাকে। ঢাকায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ আর রিকশার কোনো পরিসংখ্যান নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর এ ভয়াবহ যানজট একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সময়মতো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে ভুল পরিকল্পনায় উন্নয়নের ফলে এমন দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমাগত অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ফুটপাত দখল, ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে না চলা, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, অপ্রশস্ত সড়ক, ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল ঢাকাকে যানজটের নগরীতে পরিণত করেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন মিনিবাস, রিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণহীভাবে বাড়ায় বাড়ছে যানজট। একইসঙ্গে ফুটপাত দখল করে হকারের পণ্যের পসরা বসিয়ে দখলদারত্ব, এলোমেলো স্থান থেকে গণপরিবহনে ওঠাণ্ডনামা এবং রাস্তা পারাপারে জেব্রাক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের অভ্যাস না থাকা, আইন অমান্যে জরিমানাসহ আইনের যথাযথ প্রয়োগে প্রশাসনের তৎপরতার ব্যর্থতা নগরীর যানজট বৃদ্ধির জন্য দায়ী। যানজট নিরসনে সরকারের রাজনৈতিক সময়োপযোগী ও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারলে সুফল আনা সম্ভব বলে দাবি তাদের।

পরিকল্পনায় বড় ভুল : জানা যায়, এসটিপি প্রণয়নের জন্য সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লুইস বার্জার গ্রুপ। ২০২৪ সালের মধ্যে ৩ কোটি ৬০ লাখ যাত্রীর পরিবহন চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নে সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল তাতে। রাস্তার শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, অযান্ত্রিক যান ব্যবস্থাপনা, বৃত্তাকার নৌপথ চালু করা, পথচারী চলাচল ও নিরাপত্তা, পার্কিং নীতিমালা প্রণয়ন, পূর্ব-পশ্চিমমুখী সড়ক সম্প্রসারণের বিষয়টি তাতে গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উপেক্ষিত এসব বিষয়। দ্রুত জনপরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে তিনটি মেট্রোরেল, তিনটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছিল। তিনটি মেট্রোরেলের মধ্যে এখন শুধু উত্তরা-মতিঝিল পথে একটি রুটে মেট্রো রেলপথ চালু হয়েছে। প্রকল্প ও কর্মসূচিগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি।

২০০৫ সালে ঢাকার অভ্যন্তরীণ সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়ন, মহানগরীতে প্রবেশ ও নির্গমন, যানজট নিরসনে ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) হাতে নেয় তৎকালীন সরকার। পরে ২০১৬ সালে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপির) অধিকাংশ প্রস্তাবনা মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। চার ধাপে নেওয়া এ প্রস্তাবনা ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সমীক্ষা কার্যক্রম চলমান, আবার কোনোটির নকশা প্রণয়নের কাজ আবার কোনটির অবকাঠামো বাস্তবায়নের কাজ চলমান। পুরো পরিকল্পনার মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পগুলো স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে শেষ করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ঢাকার যানজট নিরসন করার কথা বলা হয়েছে। তবে সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। আগে স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ করার মাধ্যমে বেশি সুফল মিলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সর্বশেষ জাইকা ও ডিএমটিসিএল ২০৩০ সাল নাগাদ ১২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৬টি মেট্রো লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এই নেটওয়ার্কে ৫১টি উড়াল স্টেশন ও ৫৩টি ভূগর্ভস্থ স্টেশন থাকবে। ছয়টি লাইন মিলিতভাবে দিনে ৪৭ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।

গবেষকদের মতে, যানজট বাড়ার প্রধান কারণ বাসের মতো গণপরিবহন না বাড়িয়ে ছোট গাড়ির নিবন্ধন বাড়ানো। পার্কিং স্টেশন তৈরি না করা, ফুটপাত দখলমুক্তকরণ না করা, পরিবহনে চাঁদাবাজি চলমান রেখে আর্থিক সুবিধাভোগীদের পালন করার মাধ্যমে মেগা প্রকল্পগুলোর সুফল মিলছে না। অথচ প্রকল্প নেওয়ার আগে এসব বিষয়ে সমাধান করতে বলা উচিত। প্রকল্প অনুমোদনের আগে ছোট ছোট বিষয়গুলোর সমাধান না করে পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে কাগুজে প্রকল্পের সুবিধা দেখানোয় তা বাস্তবে সুফল মিলছে না। এখন প্রকল্পে যেসব ভুল হচ্ছে এবং ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যানিংয়ে যা করার কথা, তা যদি সঠিকভাবে করা হয় তাহলে সমস্যা দূর করা সম্ভব।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বলছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তায় বড় সংকট এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি। বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, দেশে বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি। যদিও এর মধ্যে ৩০ শতাংশ রাস্তায় চলে না। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়িও আছে। ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের গাড়ির ৪৫ শতাংশই মোটরসাইকেল এবং ২০ শতাংশ প্রাইভেট কার। এর মধ্যে বাস আছে মাত্র ০.৭ শতাংশ।

ঢাকা শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ এবং টেকসই পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা গড়তে জোর দিচ্ছেন পরিকল্পনাবিদরা। নগর এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করবার পর্যায়ক্রমিক উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি শহর পরিকল্পনা ও পরিবহন পরিকল্পনার যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। একক পরিবারের জন্য দ্বৈত নিবন্ধন নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলে যানজট অনেকটা কমে আসবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বর্তমানে গণপরিবহনে যাতায়াতে অতিরিক্ত সময় লাগে। সময় কমাতে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ছে। এতে রাজধানীতে যানজটও বাড়ছে। ফলে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই অনেকখানি যানজট কমে আসবে। এক মেট্রোরেল আমাদের যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারবে না। সরকার বেসিক সমস্যায় হাত না দিয়ে সেকেন্ডারি সমস্যার দিকে ছুটছে। বড় বড় প্রকল্প নেওয়াই এখন উদ্দেশ্য। এতে কিছু মানুষের লাভ হলেও জনগণের লাভ সেভাবে হচ্ছে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এখানে যারা নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আছেন কেউই কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বা আধুনিক গণপরিবহনের লোক নন। ফলে তারা সাধারণ বুদ্ধিতে বা বিভিন্ন চাপে এলোমেলো সিদ্ধান্ত নেন। পেশাদার না হওয়ায় গণপরিবহনের মূল সমস্যা না বুঝে উপসর্গ দেখে পদক্ষেপ নেন। সমাধানের জন্য বিজ্ঞান কী বলছে, সেদিকে মনোযোগ দেন না। লাফ দিয়ে চলে যান আইন প্রয়োগে। অথচ সিস্টেম ও প্ল্যান সঠিক হলেই তো হয়ে যায় অনেক কাজ। আমাদের পরিকল্পনা কমিশনে কোনো পরিকল্পনাবিদ নেই। ভুল প্ল্যানে আইন প্রয়োগে টেকসই ফল আসবে না এটাই স্বাভাবিক।

এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, সড়ক নিরাপত্তায় যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের কাজের জবাবদিহি নেই। দায়িত্ব অবহেলার জন্য কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না। তাই সরকার যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ এবং জনবল দিয়েও কাজ আদায় করতে পারছে না। তার মানে, সুশাসনের অভাব। এজন্য নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চালকরা ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাবেন না সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দেওয়া এ নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হয়নি। আবার ফুটপাত দখলমুক্ত হয়নি, পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি, গাড়ি দাঁড়ানোর ঠিক নেই, স্টেশন নেই- ফলে যতই জনগণের টাকায় মেগা প্রকল্প হোক তার সুফল জনগণ পাচ্ছেন না। এসটিপির প্রাথমিক যেসব কাজ রয়েছে সেগুলো আগে শেষ করার পর প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া উচিত। যত্রতত্র প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করলে যানজট নিরসনের চেয়ে যানজট আরো বাড়বে। এসব ক্ষেত্রে পলিটিক্যালি হ্যান্ডেল করা উচিত। কাজের জবাবদিহি থাকা উচিত।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমান বলেন, ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ১৮টি সংস্থা জড়িত। ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ তার মধ্যে একটি সংস্থা। এই সংস্থাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সমন্বয় ভালো থাকলে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close