গাজী শাহনেওয়াজ

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৩

তিন চাপে নির্বাচন কমিশন

পথনকশায় পদে পদে বাধা * ইভিএম অনুমোদন না হওয়া, আইন সংস্কারে ধীরগতি

যথাসময়ে কিছু প্রস্তাবনা ও প্রকল্প অনুমোদিত না হওয়ায় দৈনন্দিন কাজের কর্মসূচি ঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। এর ফলে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঘোষিত পথনকশা (রোডম্যাপ) অনুযায়ী কাজের অগ্রগতিতে এলোমেলো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অন্য সংস্থার কাছে কমিশনের পথনকশা কম গুরুত্ব পাওয়ায় অনেকটা চাপে রয়েছেন নির্বাচন কমিশনের নীতিনির্ধারকরা। প্রাথমিক পর্যালোচনায় পাওয়া তথ্যমতে, তিন ধরনের কাজে বড় রকমের চাপে পড়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি।

জানা গেছে, দেড়শ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণের জন্য ২ লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প অনুমোদন এখনো না পাওয়া, নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও সবার সমান সুযোগ নিশ্চিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ সংশোধনী প্রস্তাবনাটি আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়া এবং জনসংখ্যার প্রতিবেদন চেয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) পত্র দিলেও ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় চাপে রয়েছে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশন বরাবরই বলে আসছে, যথাসময়ে সবকিছু পাস ও অনুমোদন হয়ে যাবে। তবে শুধু আশ্বাসের মধ্যেই সময় চলে যাচ্ছে- এমন তথ্য খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। দেখা যাচ্ছে, ঘোষিত পথনকশায় ১৪ ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ইভিএম, আইন সংস্কার প্রস্তাব পাস ও চূড়ান্ত জনসংখ্যার প্রতিবেদন পাওয়া। এর বাইরে মোটাদাগে রয়েছে, নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা, প্রায় অর্ধলাখ ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ এবং সব আসনে সিসি ক্যামেরার সরঞ্জাম জোগানো ইত্যাদি।

পথনকশা ঘোষণার দিন নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেছিলেন, ইসি অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন; আস্থার ঘাটতিতে রয়েছে। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিজেদের কাজের মাধ্যমে কিছুটা হলেও আস্থা অর্জনে এগিয়েছে কমিশন। আর নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা এমিলি বলেছিলেন, পরিকল্পনা ধরেই এগিয়ে যাব আমরা। সবার সহযোগিতা পেলে অংশগ্রহণমূলক ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হব। অপর নির্বাচন কশিমনার মো. আলমগীর বলেছিলেন, এ কর্মপরিকল্পনায় সবার মতামত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যেসব বিষয় কমিশনের আওতায় রয়েছে তা রাখা হয়েছে। তবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক

সুপারিশগুলো রাখা হয়নি। রোডম্যাপের চ্যালেঞ্জগুলো ধরে, সেগুলো মোকাবিলা করে সব কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, ভোটের এখনো এক বছর (গত ১৪ সেপ্টেম্বর) চার মাস বাকি। অনেকে ইসি নিয়ে আস্থাহীনতায় থাকলেও আগামীতে কর্মকাণ্ড দেখে আস্থাশীল হবেন। কমিশনের এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতায় বেশকিছু অমিল দেখা পাওয়া যাচ্ছে।

ইসি থেকে বলা হয়েছিল, মধ্য জানুয়ারির মধ্যে ইভিএম প্রকল্পটি পাস না হলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমিশনের প্রত্যাশিত আসনে ওই প্রযুক্তিতে নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। গত শনিবার (২১ জানুয়ারি) পর্যন্ত ইভিএম প্রকল্পটি পাস হয়নি। এটি ১৭ জানুয়ারি একনেক সভায় পাস হওয়ার ইতিবাচক বক্তব্য রেখেছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী নিজেই। তিনি বলেছিলেন, আমরা নিয়মকানুনের মধ্যেই ইভিএম নিয়ে কথা বলছি। নির্বাচন কমিশনের সব প্রয়োজন আইনের আলোকে বিচার করা হবে। যত শিগগির সম্ভব ইভিএম কেনার প্রকল্প অনুমোদন করা হবে। অতিদ্রুত আমরা এটি করানোর চেষ্টা করব। জানা গেছে, আরো ২ লাখ ইভিএম কেনার জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে ইসি। তবে প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন পায়নি। বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংসদীয় সীমানা বিন্যাস একটি জটিল প্রক্রিয়া। জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম বা জিআইএস পদ্ধতি অনুসরণে কাজটি করছে কমিশন। এতে জেলা-উপজেলায় অনেক সময় ভৌগোলিক ও যোগাযোগব্যবস্থায় ত্রুটি রেখে খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর শুরু হয় সংক্ষুব্ধ এলাকার জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের পক্ষে আবেদন আসা। এগুলো যথাযথ নিষ্পত্তি করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বিদায়ি বছরে জনসংখ্যার শুমারি হওয়ায় সীমানা বিন্যাস ইসির জন্য করা বাধ্যতামূলক। ফলে নির্বাচনের বছরে চ্যালেঞ্জটিও মোকাবিলা করতে হবে ইসিকে। আগামী জুন মাসের মধ্যে কাজটি শেষ করতে হবে। এজন্য জনশুমারির প্রতিবেদন চেয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদি ব্যুরো অফিস জুনের পরে রিপোর্ট পাঠায়, তাহলে সীমানা বিন্যাস না করেই বিদ্যমান পদ্ধতিতে ছোটখাটো অভিযোগের নিষ্পত্তি করে তফসিল ঘোষণা করা হবে। একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, জনসংখ্যার প্রতিবেদন না পেলে বিভিন্ন আসন থেকে আসা আবেদনগুলোকে যাচাই করে তার আলোকে সীমানা বিন্যাস চূড়ান্ত করা হবে।

এদিকে, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত করতে হবে আইন সংস্কারের কাজটি; এর আগেই এটি দ্রুত পাস হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আইন মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে সাড়া কম। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ে তিন দফা চিঠি পাঠায় ইসি। সর্বশেষ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান নূর স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, আরপিওর সংশোধনী প্রস্তাবসমূহ নীতিনির্ধারণী বিষয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এবং বিদ্যমান আরপিওর বিধানসমূহের সঙ্গে ওই প্রস্তাবসমূহ সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, সে বিষয়সহ সার্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। রুলস অব বিজনেস-১৯৯৬ এবং অ্যালোকেশন অব বিজনেস অ্যামং দ্য ডিফারেন্ট মিনিস্ট্রিজ অ্যান্ড ডিভিশন অনুযায়ী, প্রস্তাবিত সংশোধনীসমূহ বিল আকারে প্রস্তুতপূর্বক নীতিগত/চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপনসহ জাতীয় সংসদে উত্থাপনের নিমিত্ত যাবতীয় কার্যক্রম লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের ওপর ন্যস্ত।

চিঠিতে আরো বলা হয়, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে সর্বদা সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছে। ইতঃপূর্বে নির্বাচন কমিশন থেকে আরপিওসহ নির্বাচন সংক্রান্ত অন্য যেসব আইন, বিধি, প্রবিধি, প্রজ্ঞাপন ইত্যাদি নতুনভাবে প্রণয়ন বা সংশোধনের প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে, সেসব প্রস্তাবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছে। আরপিওর প্রস্তাবিত সংশোধনসমূহের ওই রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ামাত্রই বিল আকারে প্রস্তুতপূর্বক নীতিগত/চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে আইন সংস্কার চূড়ান্ত করার কথা। হাতে আছে একমাস। এখনো পাস হয়নি এ আইনটি। ফলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল আগামী নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে অবশ্যই ঘোষণা করতে হবে। সময় আছে মাত্র নয় মাস। এখনো অনেক কাজ বাকি ইসির। কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, ইভিএম প্রকল্প অনুমোদন না হওয়া, আইন সংস্কার কাজ ধীরলয়ে চলা এবং সীমানা বিন্যাস সংক্রান্ত জনসংখ্যার প্রতিবেদন প্রকাশে বিবিএসের গড়িমসির কারণে তিন ধরনের চাপে কমিশনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close