দিলরুবা খাতুন, মেহেরপুর

  ০১ মার্চ, ২০২১

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ পাতান

কাঁধে গুলিবিদ্ধ হই কুষ্টিয়ার প্রতিরোধযুদ্ধে

একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার খবর মেহেরপুরে প্রথমে পৌঁছায় তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর কাছে। রাতেই তিনি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে মেহেরপুরকে রক্ষা করার জন্য করণীয় বিষয়গুলো স্থির করে ফেলেন। ২৫ মার্চ গভীর রাতে মাইকে প্রচার করে মেহেরপুরবাসীকে আহ্বান করা হয় প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে। রাতেই গাছ কেটে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা পাকা সড়কে ফেলে তৈরি করা হয় ব্যারিকেড। মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কে খলিসাকুন্ডুতে কাঠের সেতু ভেঙে মেহেরপুর জেলাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ২৬ মার্চ সকাল থেকে গাংনী ও মেহেরপুরের বেসামরিক প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে ২২৩টি রাইফেল তুলে দিয়ে শুরু করা হয় প্রশিক্ষণ। সেদিন থেকেই প্রতিরোধ আন্দোলনের কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। ২৬ মার্চ তৌফিক-ই-ইলাহী তার কার্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৮ মার্চ বহির্বিশে^র সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তরের টেলিযোগাযোগ স্থাপিত হয়। সেদিনই কুষ্টিয়া পুনর্দখলের অভিযানে মেহেরপুরের দুজন শহীদ হন। আহত হন ১১ জন। এসব বর্ণনা দিয়েছেন মেহেরপুরের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ পাতান।

আবদুল মজিদ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর থেকেই তিনি শত্রুর মোকাবিলা করার তাগিদ বোধ করতে থাকেন। কখন ডাক আসে সেই অপেক্ষায় সময় কাটত। তিনি জানান, ১৯৬৬ সালে আনসার বাহিনীতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করেছিলেন।

আবদুল মজিদ পাতান বলেন, ‘২৬ মার্চ তথ্য অফিস থেকে মাইকে ঘোষণা আসে, পাকিস্তানি সেনারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, আপনাদের যার যা আছে তা-ই নিয়ে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হোন।’ ঘোষণা শোনার পর একটি লাঠি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ি। বড়বাজার মোড়ে গিয়ে পাই আবুল হোসেনসহ আরো কয়েকজনকে। দলবদ্ধ হয়ে আমরা মেহেরপুর কোর্টে যাই। জেলা আনসার অ্যাডজুডেন্ট আমাদের হাতে একটি করে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও পাঁচ রাউন্ড গুলি দেন।’

পাতান বলেন, ‘আমাকেসহ ছয়জনকে পাঠানো হয় সদর উপজেলার গোপালপুর ব্রিজের কাছে। ব্রিজের পাশে একটি মোড়ের কাছে একটি কুদরতি মরিচা (প্রাকৃতিক পরিখা) ছিল, সেখানেই আমরা পজিশন নিই। সেখান থেকে মদনাডাঙ্গা পর্যন্ত দেখা যায়। ২৮ মার্চ সকাল পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। পরে আমাদের মেহেরপুর শহরের নিউমার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকালে ট্রাকে করে আমাকেসহ আরো ১২৪ জনকে পাঠানো হয় কুষ্টিয়ার মিরপুরে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে যাই মশানে। পরে আমাদের নেওয়া হয় ত্রিমোহনীর চেয়ারম্যান বাড়িতে।

আবদুল মজিদ বলেন, ২৯ মার্চ সকালে তাদের কয়েকজনকে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয় রেকি করার জন্য। এরই মধ্যে চুয়াডাঙ্গা থেকে ইপিআরের উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী একটি দল নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে পৌঁছান। রেকি শেষ করে ফিরে তাকে নকশা দেওয়া হয়। জানা গেল, কুষ্টিয়ার পুলিশ লাইনস, ওয়্যারলেস অফিস ও জিলা স্কুলে পাকিস্তানি সেনারা শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে। পরে সে নকশা অনুযায়ী তিনটি দলে ভাগ হয়ে ঘাঁটিগুলো ঘিরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেন তারা।

মুক্তিযোদ্ধা পাতান বলেন, ‘৩০ মার্চ মেজর চৌধুরীর নির্দেশে আমরা পুলিশ লাইনসে চারদিক থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করি। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। অবস্থানের কারণে তারা আমাদের যথাযথভাবে নিশানা করতে পারছিল না। একপর্যায়ে আমাদের দলের সদস্য মেহেরপুরের ফজলুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। ততক্ষণে প্রায় সব পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। থেমে থেমে এক জায়গা থেকে গুলিবর্ষণের শব্দ আসছিল। সেদিকে এগোতে গেলে এক পাকিস্তানি সেনার ছোড়া একটি বুলেট আমার ডান কাঁধে বিদ্ধ হয়। প্রথমে বুঝতে পারিনি এটি গুলি। কারণ ইটপাথরের সুরকি, গাছের ডালপালার আঘাত সহ্য করে যুদ্ধ করতে হয়েছে, মনে হচ্ছিল তেমন কিছু একটা হবে। পরে গুলি অনুভব করায় সেখানে হাত দিয়ে দেখি রক্ত ঝরছে। রক্ত দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে অনুভব করি আমি কুষ্টিয়া হাসপাতালের বিছানায়। হাসপাতালেই শুনি ওই একজন পাকিস্তানি সেনাই জীবিত ছিল। পরে গণপিটুনিতে সে মারা যায়। ৮ এপ্রিল আমাকে মেহেরপুর হাসপাতালে পাঠানো হয়।’

পাতান জানান, ওই দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের অনেকে নিহত হয়। বাকিরা ফাঁকা গুলি করতে করতে ঝিনাইদহের দিকে পালিয়ে যায়। পরে ১৪ এপ্রিল তারা বিমান হামলা চালিয়ে আবার কুষ্টিয়া দখলে নেয়।

আবদুল মজিদ জানান, মেহেরপুর হাসপাতালে চিকিৎসা শেষ হলে ভারতের নদীয়া জেলার করিমপুরে চলে যান তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close