নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩১ জুলাই, ২০২০

অনলাইনে কেনাকাটা

ভোক্তার ভোগান্তির শেষ কোথায়

এপ্রিলের ২৮ তারিখ একটি অনলাইন মার্কেট প্লেসে ৩ হাজার টাকার পণ্যের অর্ডার দিয়েছিলেন মিরপুরের বাসিন্দা এহসান আলীম অভী। এরপর এক দফায় কিছু পণ্য পেলেও ১ হাজার ৯০০ টাকার পণ্য তিনি এখনো পাননি। কাস্টমার কেয়ারে বহুবার যোগাযোগ করে টাকাও ফেরত পাননি। দেশে করোনা মহামারির এই সময়ে অনলাইনে কেনাকাটায় মানুষের নির্ভরতা যত বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে গ্রাহকের অভিযোগ। পণ্যের মান নিয়ে আপত্তি, ডেলিভারি পেতে বিলম্ব, কার্ড পেমেন্টে টাকা ফেরত পেতে সময় বেশি লাগাসহ বিভিন্ন অভিযোগ প্রতিদিন জমা পড়ছে সরকারের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে।

ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব বলছে, নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মধ্যে আনতে না পারলে এ ব্যবসার লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং মান নিয়ন্ত্রণে নজরদারির যেমন অভাব থাকবে, গ্রাহকদেরও স্বস্তি দেওয়া যাবে না। আর সরকার তরফ থেকে বলা হচ্ছে, অনলাইনে কেনাকাটা সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি সমন্বিত ব্যবস্থা চালু করার বিষয়ে কাজ চলছে। বাংলাদেশে অনলাইনে কেনাবেচার শুরু মূলত ২০১১ সাল থেকে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ (এনএসপিবি) চালু করলে ব্যাংকের মাধ্যমে অনলাইনে মূল্য পরিশোধের পদ্ধতিটি চালু হয়। মাছ, মাংস, সবজি, ফলমূল থেকে শুরু চাল, ডাল, কাপড়, প্রসাধনী, আসবাবপণ্য, বই, ইলেকট্রনিক পণ্য, গয়না এমনকি গাড়িও এখন অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে।

দেশে অনলাইনে কেনাকাটার পরিমাণ বছরে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল গত বছরই। এ বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর লকডাউনের মধ্যে অনেকেই এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রীর জন্য বিভিন্ন অনলাইন মার্কেট প্লেস এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হোম ডেলিভারি সেবার ওপর নির্ভর করছেন। দেশে এখন ২ হাজারের বেশি ই-কমার্স সাইট এবং অর্ধ লক্ষাধিক ফেসবুক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা প্রতিদিন অনলাইনে ক্রেতার অর্ডার নিয়ে পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে বাড়ি বাড়ি। কিন্তু সেবার মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন নিরুপায় গ্রাহকদের অনেকেই। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক বিকাস চন্দ্র দাস বলেন, আগের তুলনায় অনলাইন কেনাকাটায় অভিযোগ বেড়েছে এটা বলা যায়। আমরা নিয়ম অনুযায়ী এসব অভিযোগ নিয়ে কাজ করছি।

দায় নেবে কে? একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মী আমিন আল রশীদ কয়েক দিন আগে একটি ই-কমার্স সাইট থেকে টেলিভিশন কিনে প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, অনলাইন শপ দারাজ থেকে ক্রেডিট কার্ডের ইএমআই পদ্ধতিতে একটা এলজির ৪০ ইঞ্চি টিভি কিনলাম। গত রাতে টিভি হাতে পাওয়ার পরে দেখা গেল প্যাকেট এলজির নয়, ম্যানুয়াল এলজির নয়, রিমোটও এলজির নয়। শুধু টিভির গায়ে এলজি লেখা। টিভির সঙ্গে যে স্ট্যান্ড দেওয়া, সেটা ভুল। ওয়াল হ্যাঙ্গার নেই। তারপরও ডেলিভারিম্যান টিভিটা খুলে ডিশ লাইনে যুক্ত করে দেখলেন ছবির মানও খারাপ। তার মানে পুরো জিনিসটাই নকল, তাই তো? প্রশ্ন হলো, দারাজের মতো প্রতিষ্ঠানেও কি এসব হয়? তাদের কাস্টমার কেয়ারে ফোন করলাম। বলল সাত দিনের মধ্যে তাদের ধানমন্ডি অফিসে ফেরত দিয়ে যেতে। প্রশ্ন হলো, এটাকে আবার প্যাক করে সিএনজি ভাড়া দিয়ে সময় নষ্ট করে যে ফেরত দিয়ে আসব, সেটার ক্ষতিপূরণ কি দারাজ দেবে?’

গত ২০ জুন ই-কমার্স সাইট থেকে পণ্য কিনে নিজের বিড়ম্বনার কথা ফেসবুকে তুলে ধরে সাবেক সাংবাদিক শামীম আরা শিউলি। তিনি লেখেন, বন্ধুদের কাছ থেকে খারাপ রিভিউ পাওয়ার পরও একটা সুযোগ নিয়েছিলাম। দারাজ অনলাইন শপ এ চারটি পণ্য অর্ডার করেছিলাম। ভেবেছিলাম করোনার এই সময়ে দোকানপাট বন্ধ, ঘর থেকে বের হতে হবে না, অনলাইনে কিনি। কিন্তু চার পণ্যেরে জন্য আমাকে চার দিন চারবার বাসার নিচে নামতে হয়েছে। এর মধ্যে দুটির আবার সাইজ ভুল। ফেরত দিতে চাইলে যেতে হবে ধানমন্ডি। কয়েকটা জিনিসের জন্য জীবনের ঝুঁকি তো আর নেওয়া যায় না। ফেসবুক ভিত্তিক একটি অনলাইন শপ থেকে সম্প্রতি চাবির রিংসহ কয়েকটি পণ্য কিনেছিলেন একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরিরত ইরা ডি’কস্তা। সঠিক সময়ে ডেলিভারি পেলেও চাবির রিংটি চিল মরিচা ধরা।

ইরা বলেন, আকর্ষণীয় এবং দাম কম দেখেই আমি অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু এভাবে যে ঠকতে হবে বুঝতে পারিনি। কয়েকবার যোগাযোগ করার পর তারা পণ্য পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু হয়রানি যা হওয়ার, তাতো হয়ে গেছে। ক্রেতাদের বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে দারাজের বক্তব্য জানতে চাইলে কোম্পানির হেড অব পিআর, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনস সায়ন্তনী ত্বিষা ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠাতে বলেন। পরে দারাজের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ (মার্কেটিং) মো. ফয়েজ সেসব প্রশ্নের উত্তর পাঠান। দারাজের লিখিত জবাবে বলা হয়, প্রথমত, আমরা গ্রাহকদের অভিযোগ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিই এবং প্রতিটি অভিযোগকে সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করি। ব্যবস্থা নিই।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, গ্রাহকের অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়টি আরো সহজ ও গতিশীল করতে তারা বেশ কয়েকবার বসেছেন ই-কমার্স সেলের সঙ্গে, কিছু প্রস্তাবও দিয়েছেন। কীভাবে এই কাজটা অটোমেটেড করা যায়, সেটা নিয়ে ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের সঙ্গেও কাজ করছি, যাতে কাস্টমাররা তাদের কমপ্লেইন সুষ্ঠুভাবে দিতে পারেন এবং মার্চেন্টরা সিরিয়াসলি বিষয়গুলো ডিল করতে পারেন। কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি তাতে খুব বেশি হয়নি। সে কারণে এ বিষয়ে আলাদা একটি আইন দরকার বলে মনে করেন তমাল। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, ই-ক্যাব যেহেতু আইন করার পক্ষে, সেহেতু তাদের উচিত আইন করার আগেই একটি খসড়া তৈরি করে নিজেদের মধ্যে তার চর্চা করা, যাতে ভোক্তার ভোগান্তি কমানো যায়।

ই-ক্যাব একটি ড্রাফট করে সরকারকে দিতে পারে। তাদের সদস্যরা সবাই মিলে বসে সেটা করতে হবে। তারপর সরকারকে বলবে আমরা এরকম করেছি, এখন আইন করা যায় কিনা দেখুন। আগে নিজেদের প্র্যাকটিস করতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, ই-ক্যাব যেহেতু আইন করার পক্ষে, সেহেতু তাদের উচিত আইন করার আগেই একটি খসড়া তৈরি করে নিজেদের মধ্যে তার চর্চা করা, যাতে ভোক্তার ভোগান্তি কমানো যায়। ই-ক্যাব একটি ড্রাফট করে সরকারকে দিতে পারে। তাদের সদস্যরা সবাই মিলে বসে সেটা করতে হবে। তারপর সরকারকে বলবে আমরা এরকম করেছি, এখন আইন করা যায় কিনা দেখুন। আগে নিজেদের প্র্যাকটিস করতে হবে। অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা, বিড়ম্বনার বিষয়ে ভোক্তাদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে গোলাম রহমান বলেন, যেকোনো সমস্যা বোধ করলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে যাবের। তারা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close