আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

ব্রিটেনে ব্রেক্সিটপন্থিদের জয়

ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় ফিরেছে কনজারভেটিভ দল। নির্বাচনে দলটির বিপুল বিজয় আবার প্রমাণ করল ব্রেক্সিটের পক্ষেই রয়েছেন ব্রিটিশ নাগরিকরা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ৬৫০টি আসনের মধ্যে গতকাল শুক্রবার রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৬৪৯টি আসনের বেসরকারি ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ৩৬৪ আসন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টি পেয়েছে ২০৩টি আসন। দলটি গতবারের তুলনায় ৫৯টি আসন খুইয়েছে।

ব্রেক্সিট নিয়ে চলমান জটিলতার মধ্যে অনুষ্ঠিত এবারের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি গতবারের তুলনায় ৪৭টি আসন বেশি পেয়েছে। ১৯৮৭ সালে মার্গারেট থেচারের পর রক্ষণশীলরা এবারই এত বেশি আসন পেল। নির্বাচনের ফলাফল দেখে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটাররা ব্রেক্সিটপন্থিদের হাতকে আরো শক্তিশালী করল।

ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের ৬৫০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে জয়ের জন্য বরিস জনসনের দলের অন্তত ৩২৬টি আসন প্রয়োজন ছিল। স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টোরি নেতা জনসনই ডাউনিং স্ট্রিটে থাকছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী জনসন ভোটের এই ফলাফলকে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের জন্য ‘নতুন শক্তিশালী ম্যান্ডেট’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। নির্বাচনে রক্ষণশীলদের ‘ঐতিহাসিক’ বিজয়ের পর দলীয় কার্যালয়ে উল্লসিত নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের আস্থার মূল্য দিতে দিন-রাত কাজ করার প্রতিজ্ঞা করছি। তিনি বলেন, এই জয়ের মাধ্যমে তিনি ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বের করে আনবেন।

অন্যদিকে ব্রিটেনের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন ভোটের এই ফলকে ‘হতাশাজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে তিনি আর পার্টির নেতৃত্বে থাকবেন না। ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, সব দলের ভোটের হার বাড়লেও সমর্থন খুইয়েছে কেবল লেবার পার্টি। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ভোট এবার গড়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে, অন্যদিকে লেবারের ভোট গড়ে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে।

ব্রিটেনের তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটসের ভোটের হার সবচেয়ে বেশি ৪ দশমিক ২ শতাংশ বাড়লেও আসন কমে হয়েছে ১১টি। এ দলের নেতা জো সুইনসন নিজেই নির্বাচিত হতে পারেননি।

স্কটল্যান্ডে এবারের নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছে স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এসএনপি)। ৫৯টি আসনের মধ্যে ৪৮টিই জিতে নিয়েছে নিকোলা স্টারজিওনের দল, যা গতবারের চেয়ে ১৩টি বেশি। এবার ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে এসএনপির পক্ষে, যা আগেরবারের চেয়ে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।

এসএনপি নেতা নিকোলা স্টারজিওন বলেছেন, ভোটের এই ফল স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিতীয় গণভোট আয়োজনের পক্ষে একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই জয়ের ফলে পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করিয়ে নিতে সক্ষম হবেন বরিস জনসন। পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট নিয়ে সৃষ্ট যে অচলাবস্থার মধ্যে জনসনের প্রধানমন্ত্রিত্ব শুরু হয়েছিল, এবার তার অবসান ঘটবে। পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এবং এমপিদের বিরোধিতার কারণে এ পর্যন্ত ব্রেক্সিট কার্যকর করতে পারেনি কনজারভেটিভরা। এ অচলাবস্থা কাটাতেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আগাম নির্বাচন ডেকেছিলেন।

এই পরিস্থিতিতে বরিস জনসনের নেতৃত্বে ব্রেক্সিট অথকা ইইউ ছাড়ার সিদ্ধান্ত উল্টে দেওয়ার মতো আরেকটি গণভোটÑ এই দুইয়ের মধ্যে একটি বেছে নিতে গত বৃহস্পতিবার পাঁচ বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো সাধারণ নির্বাচনে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছিল যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা। রাতভর গণনা শেষে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টিকে ১৯৮৭ সালের পর সবচেয়ে বড় জয়ের সুখবর এনে দিয়েছে গতকালের ভোর। আর লেবার পার্টির জন্য এসেছে ১৯৩৫ সালের পর সবচেয়ে খারাপ ফল।

বিবিসি লিখেছে, ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় আসছে গত সোমবার সামান্য রদবদল আসতে পারে সরকারে। আর তারপর আগামী শুক্রবার পার্লামেন্টে এমপিদের সামনে তোলা হবে ব্রেক্সিট বিল। পার্লামেন্টের অনুমোদন পেলে নির্ধারিত ৩১ জানুয়ারিতেই ইইউ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ঘটবে।

এমপিদের বিরোধিতায় ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করতে না পেরে এ বছরই প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়া টোরি নেতা থেরেসা মে নির্বাচনে জয়ের খবরে বলেছেন, পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় তিনি খুব খুশি। তিনি বলেন, এই নির্বাচনে ব্রিটেনের মানুষের সামনে একটি প্রশ্ন ছিলÑ তারা ব্রেক্সিট চায় কি না। তারা এটাও বুঝতে পেরেছে যে কনজারভেটিভ পার্টি জয়ী হলেই ব্রেক্সিট হবে। পার্লামেন্টে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল এই নির্বাচনের মাধ্যমে তা কেটে যাবে। ব্রেক্সিট হবে এবং এগিয়ে যাবে।

যুক্তরাজ্যের অখ-তার ওপর এই নির্বাচনের ফলাফল কী প্রভাব ফেলতে পারে?

বিবিসির রাজনৈতিক সংবাদদাতা ক্রিস মেসন বলছেন, এই ফলাফল একটা অখ- দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের টিকে থাকার ওপর একটা চাপ তৈরি করবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে স্কটল্যান্ডের জন্য নির্ধারিত যে ৫৯টি আসন রয়েছে তার ৮১ শতাংশতেই সেখানকার প্রধান দল এসএনপি জিতেছে। এরপর আছে উত্তর আয়ারল্যান্ড।

এই প্রথমবারের মতো, জাতীয়তাবাদী দলগুলো, ব্রিটেনের সঙ্গে থাকতে চায় এমন দলগুলোর থেকে বেশি আসন পেয়েছে। এটা এখন সবাই জানে যে ইউরোপ ছাড়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যে ব্রেক্সিট চুক্তি করেছেন, তাতে ইইউর সঙ্গে উত্তর আয়ারল্যান্ডের যে সম্পর্কের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে তা যুক্তরাজ্যের অন্যান্য অংশের থেকে আলাদা।

বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের সময় নিজেকে বর্ণনা করেছেন ‘অখ-তার পক্ষের মন্ত্রী’ হিসেবে এবং সেটা তিনি করেছেন সঙ্গত কারণেই অর্থাৎ ব্রিটেন ভেঙে যেতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই। কাজেই ব্রিটেনকে একসঙ্গে রাখা অর্থাৎ ইংল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের অখ-তা টিকিয়ে রাখার চাপটা খুবই বাস্তব।

জয়ের পর বরিস জনসন যা বললেন

ব্রিটেনের কনজারভেটিভ নেতা বরিস জনসন বলেছেন, ভোটারদের আস্থার প্রতিদান দিতে তিনি রাত-দিন কাজ করবেন। নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর লন্ডনে এক বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, এই জয়ের মাধ্যমে তিনি ব্রিটেনকে ইইউ থেকে বের করে আনবেন। এখানে কোনো ‘যদি, কিন্তু’ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। যারা প্রথমবারের মতো কনজারভেটিভকে ভোট দিয়েছে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে জনসন বলেন তারা পরিবর্তন চায়। তিনি বলেন, মানুষ পরিবর্তন চায়। তাদের হতাশ করা উচিত নয়, হতাশ করব না।

সবচেয়ে বেশি নারী প্রার্থী জয়লাভ করেছে এ নির্বাচনে

ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে এবার সবচেয়ে বেশি নারী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। এর মধ্যে বিরোধী লেবার পার্টি থেকে ১০৪ জন নারী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। এদের মধ্যে চারজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী প্রার্থী রয়েছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ থেকে ৮৬ জন নারী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। ৪০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে ব্রিটেনে একজন নারী প্রার্থীও জয়লাভ করেননি। কিন্তু ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ২০০-এর বেশি হয়েছে।

বরিস জনসনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

নির্বাচনে জয়ের জন্য বরিস জনসনকে অভিনন্দন জানিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করেছেন। ট্রাম্প লিখেছেন, ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনভাবে নতুন একটি বড় ধরনের বাণিজ্য করতে পারবে। তিনি উল্লেখ করেন, এই চুক্তি অনেক বড় এবং আকর্ষণীয় হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

নিজ আসনে জয়লাভ করেছেন বরিস জনসন

কনজারভেটিভ পার্টির নেতা বরিস জনসন তার অক্সব্রিজ আসনে জয়লাভ করেছেন। তিনি পেয়েছেন ২৫ হাজার ৩৫১ ভোট এবং লেবার পার্টির প্রার্থী আলি মিলানি পেয়েছেন ১৮ হাজার ভোট।

আগামী নির্বাচনে দলের নেতৃত্বে থাকবেন না জেরেমি করবিন

লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেন, আগামী নির্বাচনে তিনি দলের নেতৃত্ব দেবেন না। তবে তিনি এখন পদত্যাগ করছেন না। আরো কিছু সময় দলের নেতৃত্বে থাকবেন আলোচনা চালিয়ে যাবার জন্য। তিনি বলেন, লেবার পার্টির জন্য এটি হতাশার রাত। তিনি তার ভোটার, পরিবার এবং বন্ধুদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন সহযোগিতার জন্য। করবিন তার আসনে জয়লাভ করেছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close