হাসান ইমন ও জিয়াউদ্দিন রাজু

  ২০ জুন, ২০১৯

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির চার মাস

নতুন সাজে ওয়াহিদ ম্যানসন

চার মাস যেতে না যেতেই মানুষ ভুলে যেতে বসেছে ভয়াবহ চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির ঘটনা। নতুন করে রুপালি দেয়ালে সাজতে শুরু করেছে চুড়িহাট্টা এলাকাটি। এখন আর আগুনে পোড়া দুর্গন্ধ নাকে আসে না। পুড়ে যাওয়া ভবনগুলোর প্রায় সব সেজেছে রঙিন সাজে। সংস্কারে বাদ যায়নি সেই ওয়াহেদ ম্যানসনও। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও পলেস্তারা ও দেয়াল উঠানোর কাজ অনেকটা এগিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেট স্থানীয়ভাবে রাজনীতিতে খুবই শক্তিশালী। এছাড়া সরকারের তদারকির যথেষ্ট অভাব থাকায় এরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার ৬৪ নম্বর হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এরপরই একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরা এলাকা। আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে বাড়তে অত্র এলাকা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে মানুষ। কিন্তু ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনের সড়কে ও ভবনের ভেতরে থাকা মানুষরা কোনো দিকে দৌড়ানোর সুযোগ পায়নি। পুড়ে কয়লা হয়ে যান ৬৯ জন। আবার হাত, পা, পেট পুড়ে ৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিছু দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে তাদের একজন মারাও যান।

সেই ভয়াবহ ট্র্যাজেডির স্মৃতি ভুলতে শুরু করেছেন চুড়িহাট্টার বাসিন্দারা। ওয়াহেদ ম্যানসনে এখন আর পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন নেই। ক্ষতবিক্ষত ভবনের কোনো চিহ্ন নেই। নেই মানুষের আহজারি। ভবনটির চারদিকের দেয়াল ও ভেতরের রুমগুলোর পলেস্তারার কাজ শেষ হয়েছে। একইসঙ্গে দুই তলার ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া দেয়ালটি অর্ধেক উঠানো হয়ে গেছে। তাছাড়া চারদিকের পরিবেশ প্রাণ-চঞ্চল হয়ে উঠেছে। দোকান-ঘরবাড়ি সব সংস্কার করা হয়েছে। হলুদ-সবুজ নানা রঙে রাঙানো হয়েছে পুড়ে যাওয়া ভবনগুলো। চালু হয়েছে হোটেল, মুদি দোকানসহ বিভিন্ন স্টেশনারি দোকান।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এরই মধ্যে ভবনের নিচতলা মেরামত শেষে দ্বিতীয় তলায় কাজ চলছে। ভবনটির দ্বিতীয়তলার উত্তর পাশের দেয়ালে ইটের গাঁথুনি দিয়ে অর্ধেক দেয়াল উঠিয়ে রেখেছেন শ্রমিকরা। নিচের পিলারগুলোর বিভিন্ন অংশ ভেঙে নতুন করে প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, গত ৬ মে এ ভবনটির সংস্কার কাজ শুরু হয়। টানা একমাস কাজ চালিয়ে দেয়াল ও পিলারে পলেস্তারা লাগানো হয়েছে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হলে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এ কাজটি করার সঙ্গে জড়িত আছেন মালিক হাছানের শ্যালক রুবেল। ভবনটি সংস্কার শুরু আগে দোকনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি। এছাড়া পাশের ভবনগুলো সংস্কার করে রঙ লাগানো হয়েছে। চলছে ব্যবসায়িক নানা কার্যক্রম।

স্থানীয় বাসিন্দা ও একতা সংঘের সাধারণ সম্পাদক আসিক উদ্দিন সৈনিক বলেন, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ওয়াহেদ ম্যানসনের সংস্কার কাজ শুরু হয়। ঈদের এক সপ্তাহ আগে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। নিচতলার পিলার ও দেয়ালের পলেস্তারার কাজ অনেকটা শেষ পর্যায়ে। সিটি করপোরেশন এ ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করার পরও ভবন মালিকরা কীভাবে সংস্কার কাজ চালাচ্ছে? আবার শুনেছি নতুন করে দোকানপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে সালামিও নিয়েছেন। সরকার যদি কঠোর থাকত তাহলে এটা কখনো সম্ভব হতো না।

তিনি আরো বলেন, এ ভবনটি যেভাবে সংস্কার চলছে, সেটাতে ঝুঁকি রয়ে গেছে। এ ভবনটিতে যে ব্যবসায়ীরা দোকান ভাড়া নেবে তারাও ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। আবারো ঘটে যেতে পারে আরো বড় ধরনের ট্র্যাজেডি। আমরা আর ট্র্যাজেডি চাই না। চাই সরকার এ বিষয়টা নিয়ে আরো সতর্ক হোক।

জানা গেছে, গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার এই ভবনটি অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন ও বুয়েটের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ওয়াহেদ ম্যানশনের স্ট্রাকচারাল প্রতিবেদন ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) অগ্নিকা-ের কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ডিএসসিসি ও বুয়েটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘আগামী (প্রতিবেদন প্রকাশের দিন থেকে) ৪৫ দিনের মধ্যে ভবনটির ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট (ডিইএ) করতে হবে। ডিইএ’র রিপোর্ট অনুযায়ী পরের ১৫০ দিন বা পাঁচ মাসের মধ্যে নতুন করে ভবনটির প্রয়োজনীয় মজবুত (রেট্রোফিটিং) করার কাজ করতে হবে। এ দুই সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ভবনটি ব্যবহার করা যাবে না।’

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে নতুন করে নির্মাণ কাজ চলছে, গভীর রাতে পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল প্রবেশের বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক (বাপা) ড. আবদুল মতিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এখানে সরকারের দায়িত্বশীলতা প্রয়োজন। কেন কর্তৃপক্ষ এ ধরনের বিষয়ে নরম হয়ে যায় তা আমরা সবাই জানি। এছাড়া ভবন মালিকদের লবিং এতটাই শক্তিশালী তারা সরকারকে নমনীয় করতে সক্ষম হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা ঘটনা ঘটার কিছু দিন পরে আমরা সেটাকে শীতল করে দেখি। যার কারণে এ বিষয়গুলো শীতল হয়ে গেছে। সরকার ও প্রশাসনের সঠিক তদারকি-দায়িত্বহীনতার অভাবে এগুলো পুনরাবৃত্তি ঘটে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এ ধরনের ঘটনায় সরকারের তত্ত্বাবধানের অভাব রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো নতুন করে নির্মাণ হচ্ছে তাতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। তদারকি না থাকলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close