বিশেষ প্রতিনিধি

  ২০ মার্চ, ২০১৮

কফিনবন্দি হয়ে ফিরল ওরা

নিথর দেহ বুঝে নিলেন অশ্রুসিক্ত স্বজনরা

কেউ গিয়েছিলেন আনন্দ ভ্রমণে দলবেঁধে হিমালয় দেখতে। পেশাগত কাজেও গিয়েছিলেন কেউ। এক দম্পতি গিয়েছিলেন একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে কিছুদিন নীরবে সময় কাটাতে। সেমিনারে যোগ দিতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারাও ছিলেন। হাতের মেহেদি শুকোয়নি এমন নতুন দম্পতি গিয়েছিলেন মধুচন্দ্রিমায়। শহুরে জীবনের দীর্ঘ ক্লান্তি মুছে নতুন উদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে কেউ গিয়েছিলেন শক্তিসঞ্চারণে। সরকারি মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ছিলেন। গিয়েছিলেন সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, সংস্কৃতি ও সমাজকর্মী, সৃজনশীল মানুষ। সঙ্গে তো তারুণ্যদীপ্ত ক্যাপ্টেন ক্রুরা ছিলেনই।

ঠিক এক সপ্তাহ পর সেই মানুষগুলোই আরেক সোমবার গতকাল নেপাল থেকে দেশের মাটিতে ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে। জীবিত নয়; স্বজনরা পেল স্বজনের মরদেহ। গত ১২ মার্চ নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশের ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ৫১ জনের। ওই বিমানের ক্যাপ্টেন ও ক্রুসহ বাংলাদেশের প্রাণ গেল ২৬ জনের। চোখের নিমিষেই ঝরে গেল কত স্বপ্নের ফুল। কত সংসার থেমে গেলে মুহূর্তেই। কত সৃজনশীলতা, রোদ্দুজ্জ্বল আগামী, কত সম্ভাবনা বিনষ্ট হলো অকালেই। ছাইভস্ম দেহ বাতাসে ওড়ালো কত সোনালী ডানার চিল। এখন হারানো স্বজনদের ঘরে, বন্ধুর মনে, কর্মস্থলে, পথেঘাটে চাপ চাপ শোক। কেবলই কান্না দুঃখ চারপাশে। বিশেষ করে গতকাল মরদেহগুলো দেশে পৌঁছার পর সেগুলো ঘিরে স্বজনদের যে গগনবিদারী কান্না, সে কান্না এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। নিহতের স্বজন তো বটেই, চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি উপস্থিত সাধারণ মানুষও। রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু করে আর্মি স্টেডিয়ামে নিহতদের নামাজে জানাজা ও মরদেহ হস্তান্তরÑ পুরো প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে শোকাশ্রুতে। মরদেহ নিতে আসা স্বজনদের চোখের জলে ভিজেছে কফিন। সে অশ্রু কাঁদিয়েছে দেশকে। কেঁদেছে আকাশ বাতাস। এমনকি টেলিভিশনে সে ধারণকৃত দৃশ্য দেখে কেঁদেছে সেটের সামনে বসে থাকা দর্শকরা।

নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ২৩ জনের মরদেহ নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি উড়োজাহাজ গতকাল সোমবার বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে কাঠমান্ডু থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। সোয়া ৪টার দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে মরদেহগুলো হস্তান্তর করেন বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল আবু এসরার। বিমান পরিবহনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামালও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে শিগগির দেখা করবেন বলে জানিয়েছেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল বিকেলে আর্মি স্টেডিয়ামে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ২৩ জনের জানাজা শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, যার যা প্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রী তাই দিয়ে সহায়তা করবেন। এ সময় তিনি ‘নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারকে ইউএস-বাংলা কী দেবে, তা তাদের ব্যাপার’-বলেও মন্তব্য করেন।

উড়োজাহাজ থেকে প্রথমেই নামানো হয় ইউএস-বাংলার প্রধান বৈমানিক আবিদ সুলতানের মরদেহ। তার কফিন একটি অ্যাম্বুলেন্সে তোলার পর একে একে অন্যদের কফিনও নামিয়ে আনা হয়। পরে বিমানবন্দর থেকে ২৩ জনের কফিন অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে। সেখানেই আত্মীয়, বন্ধু, স্বজনদের সঙ্গে শেষবার মিলিত হন না ফেরার দেশের এই ২৩ যাত্রী। বিমান দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের স্বজনদের মধ্যে যারা কাঠমান্ডুতে গিয়েছিলেন, তাদেরও আগেই দেশে ফিরিয়ে এনে আর্মি স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশে থাকা পরিবারের অন্য স্বজনরাও দুপুরের পর থেকে আর্মি স্টেডিয়ামে জড়ো হতে শুরু করেন। এ সময় তাদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে স্টেডিয়ামের পরিবেশ।

বিকেল ৫টা ১০ অ্যাম্বুলেন্সগুলো আর্মি স্টেডিয়ামে পৌঁছানোর পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাঁধে করে কফিন বয়ে নিয়ে মঞ্চের ওপর সারি করে রাখেন। মাওলানা মাহমুদুর রহমানের পরিচালনায় মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, আত্মীয়-বন্ধু-স্বজনসহ বিভিন্ন শ্রেণি পোশার মানুষ আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজায় অংশ নেন। এ সময় সেখানে প্রিয়জনের লাশ নিতে আসা স্বজনদের আহাজারিতে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নিহত ব্যক্তিদের স্বজন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ও সাধারণ মানুষ জানাজায় অংশ নেয়।

জানাজা শেষে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে তার সামরিক সচিব, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে পৃথকভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় সেনাবাহিনীর প্রধান ও বিমানবাহিনীর প্রধান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে মরদেহ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরে একে একে নাম ডেকে ডেক মরদেহ হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে। ২৩ জন পুলিশ কর্মকর্তা আলাদা আলাদা ফাইলে তথ্য সংগ্রহ ও ফরম পূরণ করে ছবি ও পাসপোর্টের তথ্য দেখিয়ে মরদেহ হস্তান্তর করেন।

ইউএস-বাংলার ফ্লাইট বিএস২১১ গত ১২ মার্চ ঢাকা থেকে রওনা হয়েছিল চার ক্রুসহ ৭১জন আরোহী নিয়ে, সেদিনও ছিল সোমবার। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হলে ২৬ জন বাংলাদেশিসহ ৫১ জনের মৃত্যু হয়। নিহতদের মধ্যে ২৩ জনের মরদেহ শনাক্ত করার পর নেপালি কর্তৃপক্ষ কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করে। গতকাল সকালে দূতাবাস প্রাঙ্গণে প্রবাসী বাংলাদেশি, বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ইউএস-বাংলার উপস্থিত কর্মকর্তারা তাদের জানাজায় অংশ নেন। জানাজা শেষে ২৩টি কফিন পাঠানো হয় সেই ত্রিভুবন বিমানবন্দরে। সেখান থেকেই ঠিক এক সোমবার পর জীবিত মানুষগুলোই মরদেহের কফিন হয়ে দেশের পথে তাদের ফিরতি যাত্রা শুরু করে দুপুর আড়াইটায়, বিমানবাহিনীর কার্গো ফ্লাইটে চড়ে।

এই ২৩ জনের মধ্যে ইউএস-বাংলার পাইলট আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশীদ এবং কেবিন ক্রু খাজা হোসেন মো. শফি ও শারমিন আক্তার নাবিলা রয়েছেন। আর যাত্রীদের মধ্যে আছেন ফয়সাল আহমেদ, বিলকিস আরা, বেগম হুরুন নাহার বিলকিস বানু, আখতারা বেগম, নাজিয়া আফরিন চৌধুরী, রকিবুল হাসান, হাসান ইমাম, আঁখি মনি, মিনহাজ বিন নাসির, ফারুক হোসেন প্রিয়ক, তার মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী তামারা, মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহিরা তানভিন শশী রেজা, বেগম উম্মে সালমা, মো. নুরুজ্জামান, রফিক জামান, তার স্ত্রী সানজিদা হক বিপাশা, তাদের ছেলে অনিরুদ্ধ জামান।

মরদেহ না আসা তিন বাংলাদেশি আলিফুজ্জামান, পিয়াস রায় ও নজরুল ইসলামের মরদেহ রোববার পর্যন্ত শনাক্ত করা বাকি ছিল। নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস সোমবার সকালে বলেন, ওই তিন বাংলাদেশির মধ্যে আরো একজনের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে, তবে নেপালি কর্তৃপক্ষ এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পেলে এই একজনের মরদেহ আগামীকাল বুধবার বিমানের ফ্লাইটে আনা হতে পারে। বাকি দুজনের মরদেহ পাঠানো বিষয়টা নির্ভর করবে শনাক্ত করতে কতদিন লাগে তার ওপর। শনাক্ত হলে একই প্রক্রিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। নেপালে অবস্থানরত বাংলাদেশ চিকিৎসক দলের সদস্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ এর আগে জানিয়েছিলেন, চিহ্ন দেখে বা অন্যভাবে ওই তিনজনকে শনাক্ত করা না গেলে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে গতকাল সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শিগগিরই বাকি তিনজনের লাশ নিয়ে আসা হবে। তাদের ময়নাতদন্ত শেষ হলে নিয়ে আসব। এটা একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে যত দ্রুত সম্ভব লাশ নিয়ে আসা হবে।

১২ মার্চ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার ড্যাস ৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৪ ক্রুসহ বিমানের ৭১ জনের সবাই হতাহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৬ বাংলাদেশি, ২২ নেপালি, ১ জন চীনাসহ ৪৯ জন নিহত হন। আর ১০ বাংলাদেশি, ৯ নেপালি, ১ মালদ্বীপের নাগরিকসহ ২০ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের কাঠমান্ডুর তিনটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। আর নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ নেওয়া হয় টিচিং হাসপাতালের মর্গে। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় যে ১০ বাংলাদেশি বেঁচে গেছেন, তাদের মধ্যে ছয়জন ইতোমধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন। একজনকে ভারতে ও একজনকে পাঠানো হয়েছে সিঙ্গাপুরে। কাঠমান্ডু মেডিক্যালে চিকিৎসা নেওয়া শাহীন ব্যাপারী গতকাল রোববার বিকেলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছালে বিমানবন্দর থেকেই তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন ইয়াকুব আলী ও কবির হোসেন কাঠমান্ডুতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে কবির হোসেনকে ভারতে ও ইয়াকুব আলীকে দেশে আনা হতে পারে বলে জানা গেছে। আহত যাত্রীদের সুচিকিৎসার স্বার্থে হাসপাতালে ভিড় না করার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist