আব্দুর রহমান

  ২৩ অক্টোবর, ২০১৭

নিবন্ধ

অবক্ষয় রোধে চাই মূল্যবোধ

মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য-সবার জানা মর্মকথাটি আমাদের সমাজে যেন হয়ে পড়েছে অর্থহীন। কোথায় মানুষ, মনুষ্যত্ব আর মানবতা। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ নেই বললেই চলে। সিলেটের খাদিজা থেকে কয়েক দিন আগে নেত্রকোনার জান্নাতুল প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় বখাটের দায়ের কোপে ক্ষতবিক্ষত হলো। রাজনের পর সাগরকে চুরির অপরাধে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। রাকিবের পর সোহেলের পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে কেড়ে নেওয়া হলো জীবন প্রদীপ। ঈদের দিনেও পটুয়াখালীর বাউফলে গণধর্ষণের শিকার হতে হলো এক নারীকে। তাহলে কোন সমাজে বাস করছি আমরা? মিয়ানমার সরকার গণহত্যা ও গণধর্ষণ করে যে বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে, তার থেকে কি আমাদের সমাজে ঘুরে বেড়ানো নরপশুরা কম বর্বরতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বার্মিজরা বর্বর আমরা কি সভ্য? বাঙালি জাতি তো এত বর্বর কোনোকালেই ছিল না। তবে কি সভ্যতার ক্রমবিকাশ আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে? আইনের শাসনের অনুপস্থিতি আর বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা কি তবে সমাজে বাড়াচ্ছে সামাজিক অপরাধ? নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনের পাঠ পাচ্ছে না বলেই কি আমাদের সন্তানরা হারিয়ে ফেলছে মূল্যবোধ? আর ঠিক এ কারণেই সামাজিক এমনকি পারিবারিক বন্ধনগুলোও আজ নড়বড়ে। নিকট অতীতেও আমরা দেখেছিলাম এদেশে ছিল যৌথ পরিবার, যা একান্নবর্তী পরিবার নামেও পরিচিত। যৌথ পরিবারগুলো ছিল সামাজিক অনুশাসন আর আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। এই পরিবারগুলোয় বসবাসকারীরা অর্জন করত মানবিক মূল্যবোধ ও একে অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল মনোভাব। বর্তমান বাংলাদেশে যৌথ পরিবারের সংস্কৃতি বিলীন হওয়ার পথে। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে মানুষ হয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থবাদী। সমাজ হয়ে পড়ছে বিকারগ্রস্ত। দুর্নীতি, অনিয়ম আর গণতন্ত্রহীনতার বাংলাদেশে অনিয়মই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেই আইনের শাসন আর বেঁচে থাকার অধিকার। মানবাধিকার পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, আমাদের কারোই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পর্যন্ত নেই। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, কালক্রমে দেশে সব পণ্যের দাম বাড়লেও যেন কমেছে শুধু মানুষের জীবনের দাম। টেলিভিশন ও পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই যার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রতিদিনই দেখতে পাই একাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড। কেউ প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আবার কেউবা ধর্ষণের শিকার ও খুন হয়ে পড়ে থাকছে রাস্তার পাশে। মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ নামের পশুরা সামান্য ঘটনায় কেড়ে নিচ্ছে একে অন্যের প্রাণ। জিঘাংসা চরিত্রার্থে পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতা-মাতাকে, ভাই ভাইকে, স্বামী স্ত্রীকে কখনো কুপিয়ে, কখনো বিষ প্রয়োগে বা শ্বাসরোধে করছে হত্যা। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যেন কিছুতেই লাগাম টানতে পারছে না এসব হত্যার। অবশ্য শুধু আইন প্রয়োগে সমাজের এই ব্যাধি নিয়াময়যোগ্য নয়। এজন্য চাই সামাজিক বিপ্লব। যার মাধ্যমে গড়ে উঠবে একটি সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের সমাজ।

মানবের মানসপটে লুকিয়ে থাকে দানব। বিকৃত মানসিকতার মানুষ সুযোগ পেলেই দানবের আকার ধারণ করে। নইলে তিন-চার বছর বয়সের শিশুকন্যাকে কিভাবে ধর্ষণ করা হয়। যারা এই লুক্কায়িত দানবকে নিয়ন্ত্রণ করে চলতে পারে, তারাই সত্যিকার মানুষ। তারাই পারে আলোকিত সমাজ গঠন করতে। কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে দানবগুলো দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জান ও মাল। মানুষ এতই পৈশাচিক মনোবৃত্তিসম্পন্ন হয়েছে যে, রাজনের মতো শিশুদের পিটিয়ে হত্যা করতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। তাছাড়া প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও পাওয়া যাচ্ছে অজ্ঞাত কিংবা পরিচিত মানুষের লাশ আবার কখনো গলাকাটা লাশ। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারী নির্যাতন আর ধর্ষণ। কয়েক দিন আগে প্রকাশিত জরিপে জানা গেছে, পারিবারিক নির্যাতনের পঞ্চাশ শতাংশই হচ্ছে যৌতুককেন্দ্রিক। কয়েক দিন আগে মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই দেশে ১০৬ শিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৬৯ জন। আড়াই বছরের শিশু থেকে সত্তরোর্র্ধ্ব নারীও রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষক নামক দানবের হাত থেকে। তাছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি আমাদের হীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীদের আমরা মর্যাদার আসনে এখনো বসাতে পারিনি। নারীকে এখনো ভোগের সামগ্রীই বিবেচনা করা হয়। নারীকে নারী হিসেবে না দেখে দেখতে হবে একজন মানুষ হিসেবে। বেগবান করতে হবে নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। কিছুতেই কমছে না নারীর প্রতি সহিংসতা আর বৈষম্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, নারীরা মায়ের জাতি, তারাই বহন করে সমাজের স্বাভাবিক প্রজনন ধারা। টিকিয়ে রাখে একটি জাতিকে। তাই নারী নির্যাতন রোধে প্রয়োজন পারিবারিক মূল্যবোধ আর সহমর্মিতার বন্ধন। কারণ আমরা জানি, ‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’

মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ জীবন দিয়েছিলেন আর দুই লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন শোষণ-নিপীড়নমুক্ত সমাজ গঠন করতে। তারা চেয়েছিলেন একটি স্বাধীন দেশ আর আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। যে সমাজে নারী-পুরুষ ভোগ করবে সমান অধিকার। এখন প্রশ্ন হলো, স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও কি আমরা পেরেছি পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হতে? নাকি পেরেছি নারী ও শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজব্যবস্থা গড়তে? আমাদের মাঝে রয়েছে কি সত্যিকার দেশপ্রেম আর স্বাজাত্ব্যবোধ? পেয়েছি কি আমরা নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার? আমরা কি তিমিরবিনাশী না হয়ে তিমিরবিলাসী জাতিতে পারিণত হচ্ছি না? যে দেশে সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই; সে দেশের শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া অনর্থক নয় কি? কারণ মানুষের জন্মগত যে অধিকার তা হলো বেঁচে থাকার অধিকার। অথচ দেশে নানা সামাজিক ও পারিবারিক কারণে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ড নিয়ন্ত্রণে করা যাচ্ছে না। অবশ্য সামাজিক ভারসাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা। আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। নানা বিষয়ে শিক্ষাদানের পাশাপাশি তাদের শেখাতে হবে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ। তাদের মানসে আনতে হবে ধর্মীয় অনুশাসন। তাদের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটিয়ে গড়ে তুলতে হবে দেশপ্রেমিক, সৎ ও ভালো মানুষ হিসেবে। অপ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও মাদকের ভয়াল থাবা থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। কেননা পারিবারিক মূল্যবোধ একজন মানুষের সারা জীবনের পাথেয়। অস্থির সমাজ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সামাজিক মূল্যবোধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের লালন। দেশে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের শাসন। ফিরিয়ে আনতে হবে সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ। পরিশেষে কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি-‘কামের চেয়ে প্রেম বড়, ভোগের চেয়ে উপভোগ, এ সংস্কার না জন্মালে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না। আর সংস্কৃতিবান মানুষ না হলে মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গঠনও সম্ভব নয়। আবার সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধও সম্ভব হয় না।’ সুতরাং উপরোক্ত উক্তিটি আমাদের মানসপটে ধারণ করলেই কেবল নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার আর গঠিত হবে মূল্যবোধের সামাজ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist