ইসমাইল হোসেন

  ২৬ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

ইতিহাস বিকৃতির অপবাদ থেকে মুক্তি চাই

বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিশ্বে অদ্বিতীয়। ১৯৭১-এর মার্চ মাস থেকে বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। মার্চের প্রতিটি দিন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দু-দফায় যথাক্রমে ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ ও ১৭ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি জান্তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন এবং ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেন। প্রতিবাদে ২ মার্চ বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার ঘোষণা রাজনৈতিক বিষয় বলেই ৭০-এর নির্বাচনে ম্যানডেটপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ এই পঙ্ক্তির মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হয় এবং মানুষ মুক্তিসংগ্রামের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়। পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তিকামী জনতা এ ধরনের নেতৃত্বের বক্তব্যের প্রতি আস্থা রেখেই দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পেরিয়ে সশস্ত্র লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণায় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধীর ভাষণের শব্দমালা জানলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তাৎপর্য বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিযোগ এড়াতে সেদিন সরাসরি ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যে ব্রিটিশকে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে হবে।’ কাজেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক অবান্তর বিষয় বলে মনে করি। ১৯৭১-এর ২২ মার্চ রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু ও জুলফিকার আলী ভুট্টো বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক ব্যর্থ হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা আন্দোলনে আছি এবং লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’

২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সন্ধ্যায় গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। ওইদিন মধ্য রাতে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সারা দেশে প্রায় অর্ধলক্ষ বাঙালিকে নিমর্মভাবে হত্যা করে। এই অভিযানের শুরুতে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পূর্বক্ষণে বঙ্গবন্ধু আবারও স্বাধীনতার ঘোষণায় বলেন, ‘শেষ শত্রু বিদায় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। আজ থেকে আমরা স্বাধীন।’

মহান মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাস একটি কিন্তু চিত্রকর অসংখ্য। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, ছাত্র, যুবক, নারী বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মকতাণ্ডকর্মচারী, কামার, কুমার জেলে, তাঁতি, মুচি, কৃষক, শ্রমিকসহ সমাজের সব অংশের মানুষ সর্বস্ব ত্যাগ করে তাদের নিপুণ তুলির আঁচড়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরাট ক্যানভাস পরিপূর্ণ করে পাকিস্তানিদের পরাস্ত করেছে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো এখনো দেশে স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণ, বিকৃত ইতিহাস চর্চা চলছে। ভুল তথ্য ও তথ্য গোপন করে ব্যক্তি এবং দলবিশেষের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পর্ণাঙ্গ, প্রকৃত এবং সত্য ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হয়নি। যে যেভাবে পারে, যার যেখানে স্বার্থ সে সেভাবে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে ইতিহাস রচনা করে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থাৎ কি বুঝে আমজনতা কতটুকু অংশ নিয়েছিল, তাদের উপলব্ধি ও ভাষা জ্ঞানের পরিধি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

অনেকে মনে করেন, ১৯৭২ সালে রচিত শাসনতন্ত্র যে চারটা স্তম্ভের ওপর রচিত হয়েছে ‘জাতীয়তাবাদ, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতাই’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অনেকে বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ব্রত। আবার কেউ কেউ স্বাধীনতার ইশতেহারের কথা উল্লেখ করেন। ১৭ এপ্রিল ইশতেহারে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘সাম্য, মানবসত্তার মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার।’ আবার অনেক গবেষক বলেছেন, পাকিস্তানিদের শোষণ, জুলুম, বঞ্চনায় মানুষ যখন অতিষ্ঠ, তখন আম জনতা তার চেতনার স্তর অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে পাকিস্তানি জান্তাবাহিনীর সঙ্গে আমরা আর থাকব না। এই সিদ্ধান্তই তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

দীর্ঘ ৯ মাসের শ্বাসরুদ্ধকর রণাঙ্গনের চিত্র, স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি (ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত), স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন দেশীয় নেতৃত্ব, ভারত, চীন, আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা ইত্যাদি ইতিহাসে যতক্ষণ লিপিবদ্ধ করা হবে না, ততক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মহল ও দেশে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব- আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য দলের ভূমিকা সেটা পক্ষে কিংবা বিপক্ষে হোক তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। একজনকে ছোট বা আড়াল করে, অন্যজনকে বড় করার প্রচেষ্টা-বালির পাহাড়ের মতো। স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অনন্য অসাধারণ ভূমিকাসহ আওয়ামী লীগের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, কমরেড মণিসিংহসহ প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নেতাদের ভূমিকা যথাযথভাবে উপস্থাপিত হলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি ও সামগ্রিক চিত্র জানতে ও বুঝতে পারবে। শুধু তখনই জাতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপবাদ থেকে নিষ্কৃতি পাবে।

লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close