রবিউল আলম

  ১৬ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

রক্ত দিতে কেন সংশয়?

‘নিয়মিত রক্তদানে বার্ধক্যজনিত জটিলতা দেরিতে আসে’, ‘রক্তদানে উপকৃত হন দাতা নিজেই’, ‘রক্ত না দিতে পারলে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বাঁচানো সম্ভব নয়’, ‘নিয়মিত রক্তদানে বহুমাত্রিক উপকার’, ‘রক্তদানে ভয়কে করো জয়’, ‘এক ব্যাগ রক্তদানে বাঁচবে একটি প্রাণ’, ‘নিয়মিত রক্তদান একটি ভালো অভ্যাস’, ‘করিলে রক্তদান, বাঁচিবে একটি প্রাণ’, ‘আপনার রক্ত দিন, একটি জীবন বাঁচান’, ‘সময় তুমি হার মেনেছ রক্তদানের কাছে, ১০টি মিনিট করলে খরচ একটি প্রাণ বাঁচে’ বলেছি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার শিরোনামের অনুষঙ্গ। তবু কেন এত ভয়, রক্ত দিতে জাগে সংশয়।

ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবার রক্তই একই রকম, চিরায়ত লালচে রং যেটা সাধারণ মানুষের কাছে লাল ভালোবাসা হিসেবে পরিচিত। সবকিছুতেই বিভেদ থাকলেও রক্তের রঙের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। কিন্তু মানুষে মানুষে কত তফাৎ! কেউ রক্ত দেয়। আবার কেউ রক্ত নেয়। কেউ কেউ তো এমনও আছে, যারা রক্ত বইয়ে দিয়ে নিষ্ঠুর জিঘাংসায় লিপ্ত হয়। খুন-পিয়াসী ‘খুনিয়া’ হয়ে ওঠে। মানবতার গায়ে এঁকে দেয় কলঙ্ক-চিহ্ন। কিন্তু এ রক্তই অন্যজন ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার অমর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুমূর্ষু ভাইয়ের জন্য আনন্দচিত্তে ও অকাতরে বিলিয়ে দেয়। মনের আঙিনায় রয়ে যায় একজন ডোনার হিসেবে। শুধু সাওয়াব-পুণ্যের আশায়; আর একটুখানি হাসির ঝিলিক দেখতে কিংবা দেখাতে।

২০০৫ সালে ৫৮তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশের সময়, রক্তদানের তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এটিকে একটি বার্ষিক বৈশ্বিক ইভেন্ট হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৪ সালে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস উদযাপন করা হয়। এরই পরিক্রমায় প্রতি বছর ১৪ জুন পালিত হয় বিশ্ব রক্তদান দিবস।

রক্তদাতা বা দানের উপযুক্ত শর্তের মধ্যে ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়স্ক যেকোনো সুস্থ নর-নারী রক্ত দাতা হতে পারেন। কিন্তু রক্তদাতা আরো কিছু বিষয়ের ওপর নজর রাখতে হবে। যেমন যাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১২ দশমিক ৫-এর কম নয় এবং ওজন ৪৫ কেজির ওপরে তারা প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর রক্ত দান করতে পারেন। তবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, রক্তদানের সময় শরীরের তাপমাত্রা ও রক্তচাপ অবশ্যই স্বাভাবিক থাকা আবশ্যক। এ ছাড়া রক্তদানের একটা সূক্ষ্ম বিষয় খেয়াল রাখতে হয় যে রক্তদানের আগে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাতা কোনো এন্টিবায়োটিক ওষুধ গ্রহণ করেছেন কি না অথবা তিনি জন্ডিস, সিফিলিস, গনোরিয়া, এইডসের মতো রোগে ভুগছেন কি না।

অন্যদিকে কারা রক্ত দিতে পারবেন আর কারা পারবেন না- এ বিষয়ে রক্তের দাতা ও গ্রহীতার সম্যক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরি। গর্ভবতী এবং সদ্য সন্তান প্রসবদের রক্ত দেওয়া যাবে না। মহিলাদের ঋতুচক্রকালীনও রক্ত দেওয়া নিষেধ। আবার যারা অনিরাপদ যৌন সম্পর্কে আবদ্ধ এবং যারা মাদকাসক্ত তাদের রক্তও কোনোভাবেই গ্রহণ করা যাবে না। এ ছাড়া ৬ মাসের মধ্যে যাদের শরীরে বড় কোনো অস্ত্রোপচার হয়েছে তাদেরও রক্তদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

হৃৎপিণ্ড সবল হওয়া, ক্যানসারের ঝুঁকি কমা, রক্তে কোলেস্টেরল কমা, রক্তে লাল কণিকা সবল হওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করা, রক্তের বিভিন্ন কণিকাগুলো সতেজ, নতুন রক্তকণিকা তৈরি, রক্তদাতা তার কোনো সংক্রমণ রোগের ব্যাপারে আগাম জানতে পারা, Hemochromatosis নামক রক্তরোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলা রক্তদাতার শরীরকে উজ্জীবিত করাসহ নানা উপকারের কথা জানতে পারি।

মিরপুর ডেলটা হসপিটাল লিমিটেডের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. জেসমিন সুলতানার এক প্রতিবেদনে রক্তদানের উপকারিতা সম্পর্কে জনা যায়-

১) অপরকে রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে আপনি বহু মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারেন। এই অনুভূতি অনন্য। এটি আপনার মনকেও প্রশান্তি দেবে।

২) নিয়মিত রক্তদানে অভ্যস্ত মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল, হার্টের রোগের ঝুঁকি কমে।

৩) রক্তদানের পদ্ধতির মধ্য দিয়ে গেলে আপনার শরীরে যদি কোনো অপ্রত্যাশিত রোগ থাকে; যেমন আয়রনের ঘাটতি, হেপাটাইটিস, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি, সিফিলিস, তা জানতে পারবেন।

৪) বিশেষ কিছু রক্তদান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোগীর প্ল্যাটিলেট সংগ্রহের সময় প্ল্যাটিলেট কাউন্টও জানা যায়।

৫) আগে থেকে উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলে নিয়মিত রক্তদানে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়।

নিয়মিত রক্তদান যে ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় তা বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত। বিজ্ঞানীরা বলেন, রক্ত দেওয়ার সময় শরীরের অতিরিক্ত লৌহ উপাদান বেরিয়ে যাওয়ার ফলে রক্তদাতার ক্যানসারের ঝুঁকি কমে যায়। বছরে দুবার রক্তদানে ক্যানসারের ঝুঁকি কমে মিলার-কিস্টোন ব্লাড সেন্টার সাড়ে চার বছর ধরে ১ হাজার ২০০ লোকের ওপর গবেষণা চালিয়ে বের করেন যে, রক্তদানের সঙ্গে ক্যানসারের ঝুঁকি কমার সরাসরি সম্পর্ক আছে। যারা বছরে অন্তত দুবার রক্ত দান করেন, অন্যদের তুলনায় তাদের ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। বিশেষ করে গলা, ফুসফুস, লিভার, কোলন ও পাকস্থলী ক্যানসারের ঝুঁকি কমে যায় রক্ত দিলে এবং ক্যানসারের ঝুঁকি কমে ৩৭ শতাংশ!

গবেষকরা জানান, ৬ মাসের মধ্যে শুধু একবার রক্ত দান করলেই ক্যানসারের ঝুঁকি কমে আসে। তাই রক্ত নিজে দেওয়া এবং অন্যকেও রক্ত দিতে উৎসাহ করা উচিত। ৬০ শতাংশ রক্তদাতা স্বেচ্ছাসেবক। সুতরাং আমি আপনি সংশয় কাটিয়ে ৬০ শতাংশ রক্তদাতার অংশীজন হতে পেরেছি?

লেখক : সংবাদকর্মী ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close