প্রফেসর মো. আবু নসর

  ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪

ইতিহাস

সাতক্ষীরার প্রথম মহকুমা প্রশাসক নবাব আবদুল লতিফ

১৮৫১ সালে সাতক্ষীরার প্রথম মহকুমা প্রশাসক ও বাঙালি মুসলিম পুনর্জাগরণের অগ্রদূত নওয়াব আবদুল লতিফ। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম বাঙালি মুসলিম নেতা। নবাব আবদুল লতিফ ১৮২৮ সালে ফরিদপুরের চতুল ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ফকির মাহমুদ কলকাতার একজন স্বনামধন্য আইনজীবী ছিলেন। নবাব আবদুল লতিফ কলকাতা মাদরাসায় আরবি শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ফার্সি ও উর্দু ভাষাতেও শিক্ষা লাভ করেন। মাদরাসাশিক্ষা সমাপ্ত করার পর তিনি ১৮৪৬ সালে কিছুদিন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৮৬২ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। ১৮৬৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ মনোনীত হন। মুসলমান সমাজের প্রতি তার অবদানের জন্য সরকার তাকে ১৮৭৭ সালে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি দেন। ১৮৪৮ সালে নবাব আবদুল লতিফ কলকাতা মাদরাসায় ইংরেজি ও আরবি বিষয়ে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি ১৮৪৯ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ১৮৭৭ সালে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ১৮৫১ সালে বসিরহাট থেকে বিচ্ছিন্ন করে সাতক্ষীরা মহকুমা সৃষ্টি হলে তিনিই প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বা মহকুমা প্রশাসক নিযুক্ত হন। সাতক্ষীরা মহকুমা সদর দপ্তর কলারোয়ায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে দরিদ্র নীলচাষিদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে তিনি অক্লান্ত চেষ্টা করেন।

যোগাযোগব্যবস্থা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে উন্নত ও অগ্রগামী ছিল বিধায় কলারোয়াতেই সাতক্ষীরা মহকুমার সদর দপ্তর বা প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। কলারোয়া থানাও ১৮৫১ সালে স্থাপিত হয়।

নবগঠিত সাতক্ষীরা মহকুমার প্রথম মহকুমা প্রশাসক বা মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আবদুল লতিফ, যিনি পরে ‘খান বাহাদুর’ ও ‘নবাব’ উপাধি লাভ করেন। তার উদ্যোগে নীলকরদের অত্যাচার বন্ধ করার লক্ষ্যে ১৮৬০ সালে ইংরেজ সরকার নীল কমিশন গঠন করেন।

১০ বছর ধরে কলারোয়ায় মহকুমার প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানোর পর ১৮৬১ সালে সাতক্ষীরার প্রভাবশালী জমিদারদের প্রচেষ্টায় মহকুমা সদর দপ্তর কলারোয়া থেকে সাতক্ষীরায় স্থানান্তরিত হয়।

কলারোয়ায় কার্যালয় স্থাপন করে ১৮৫১ সালে সাতক্ষীরাকে যশোর জেলার ৪র্থ মহকুমা সৃষ্টি করা হয়। পরে ১৮৬৩ সালে ২৪ পরগনা জেলার সৃষ্টি হলে সাতক্ষীরা মহকুমা ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রকাশ থাকে যে, খুলনা এবং ২৪ পরগনা জেলার বহু আগেই যশোর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৮১ সালে ৭ জুন অবিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা হিসেবে যশোর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন যশোর জেলার বয়স প্রায় আড়াইশো বছর। ফরিদপুর, ২৪ পরগনার কিছু অংশ, নদিয়া (বর্তমানে কুষ্টিয়া) ও খুলনা নিয়ে যশোর জেলা গঠিত হয়। ১৮০০ সালে ৩৬০ দরজার যশোর জেলা কালেক্টরেট বিল্ডিং নির্মিত হয়। যশোর জেলার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ট্রিলম্যান হেংকেল।

মহকুমা হিসেবে খুলনার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮৪২ সালে। ১৮৮১ সালে খুলনা জেলা গঠিত হয়।

বাংলার মুসলিমদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে মুসলিমদের প্রভাব বিস্তার ও পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে ১৮৬৩ সালে এপ্রিল মাসে কলকাতায় নয়াব আবদুল লতিফ ‘মুসলিম সাহিত্য সমিতি’ গঠন করেন। তার প্রচেষ্টায় ১৮৭৪ সালে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে মাদরাসা স্থাপিত হয়। ১৮৬৩ সালেই কলকাতা মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি বা মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ইঙ্গ-ফারসি বিভাগ খোলা ও তদস্থলে উর্দু ও বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের লক্ষ্যে তার চেষ্টা ও অবদান উল্লেখযোগ্য।

আবদুর লতিফ ১৮৮০ সালে নবাব উপাধিতে ভূষিত হন। ১৮৮৩ সালে সিআইই উপাধি পান। ১৮৮৭ সালে উচ্চতর সম্মানের প্রতিক ‘নওবাব বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত হন। পশ্চাৎপদ ও অধঃপতিত বাংলার মুসলিমদের মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে এবং সমাজ সংস্কারে তিনি অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। তার চেষ্টায় কলকাতার আলিয়া মাদরাসায় ইংরেজি ও ফারসি বিভাগ খোলা হয় এবং মাদরাসাকে উন্নত ও আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়। তার চেষ্টায় ‘মহসিন ট্রাস্টের’ অর্থ শুধু বাংলার মুসলমানদের শিক্ষাদান বিশেষ করে দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদানে ব্যয় করার ব্যবস্থা হয়। সরকার তাকে ‘এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’ স্বর্ণপদকে পুরস্কৃত করেন।

নবাব আবদুল লতিফ মুসলিম রেনেসাঁ ও আধুনিকতার অগ্রদূত এবং বাংলার মুসলমানদের নবজাগরণের স্থপতি। স্বধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি মমত্ববোধ ও প্রশাসনিক কাজে দক্ষতা ও জনহিতকর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার কর্তৃক তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপাধি ও পদক লাভ করেন। তিনি ছিলেন উদারপন্থি ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারে স্যার সৈয়দ আহমেদের মতো নবাব আবদুল লতিফের অসামান্য অবদান ছিল বলেই তাকে ‘বাংলার সৈয়দ আহমদও’ বলা হতো। ১৮৮৫ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলার এই মহান মনীষী ১৮৯৩ সালের ১০ জুলাই কলকাতায় ইন্তেকাল করেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা

সাবেক কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড

সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ঢাকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close