আফ্রিয়া অলিন

  ২৯ জানুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে চাই জনসচেতনা

স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও দেশ থেকে মুছে যায়নি বাল্যবিয়ে। শিল্পবিপ্লবের আগে, ভারত, চীন এবং পূর্ব ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক অংশে, নারীদের কিশোর বয়সে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর পরপরই বিয়ে করার প্রবণতা ছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সমাজে মেয়েদের সাধারণত বয়ঃসন্ধির আগেই বিয়ে দেওয়া হতো। প্রাচীন গ্রিসে কম বয়সে বিয়ে এবং মাতৃত্ব উৎসাহিত করা হতো। এমনকি ছেলেদের ও তাদের কৈশোরেই বিয়ের জন্য উৎসাহ দেওয়া হতো। বাল্যবিবেয় ও কৈশোরে গর্ভধারণ খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল। বাল্যবিয়ে মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের ওপরই প্রভাব পড়ে। তবে মেয়েরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাল্যবিয়ে একটি প্রাচীন প্রথা। সভ্যতার এত যুগ পরও রয়ে গেছে এই সামাজিক কুপ্রথা। বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে বাল্যবিয়ের হার কম থাকলেও গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিয়ের হার তুলনামূলক বেশি। গ্রামে স্কুলপড়ুয়া ১৩ থেকে ১৪ বছর মেয়েদের বিয়ের হার অনেক বেশি। দরিদ্রতার কারণে এসব পরিবারে অল্প বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হচ্ছে। এমন অনেক বাল্যবিয়ের উদাহরণ আছে আমাদের দেশে। মেয়েদের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হলে তারা বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। শিশু বয়সেই তাদের ওপর সাংসারিক চাপের সৃষ্টি হয়। এতে করে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

অন্যদিকে অল্প বয়সে গর্ভধারণের কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হয়। এ ক্ষেত্রে মা ও শিশু উভয়ই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। যেমন রক্তস্বল্পতা, পুষ্টিহীনতা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এ ছাড়া অল্প বয়সে গর্ভধারণে গর্ভের সন্তান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বাল্যবিয়ের আরো একটি কুফল হলো শিক্ষার্থী ঝরে পড়া। বাল্যবিয়ের কারণে অনেকেরই পড়া লেখা বন্ধ হয়ে যায়। একজন শিক্ষিত মাই পারে একজন শিক্ষিত ও আদর্শ সন্তান গড়ে তুলতে।

বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন প্রণীত হয়েছে। বাল্যবিয়ে নিরোধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে Child Marriage Restraint Act, 1929 বাতিল-পূর্বক সময়োপযোগী করে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭ নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনের ৭ ধারায় বাল্যবিয়ে করার শাস্তির বিধান উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারী বা পুরুষ বাল্যবিয়ে করলে তিনি অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। আরো বলা আছে, যদি অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো নারী বা পুরুষ বাল্যবিয়ে করেন তবে তিনি অনধিক ১ মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০,০০০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। কিন্তু এই আইন থাকা সত্ত্বেও তার যথার্থ প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সরকার বাল্যবিয়ে নিরোধের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রম চালু, বিনামূল্যে বই বিতরণ, বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন জায়গায় সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এসব প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে বাল্যবিয়ের কুফলগুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়। তবু বাল্যবিয়ে রোধ হয়নি।

বাল্যবিয়ের মূল কারণ দরিদ্রতা। অর্থের অভাবে হতদরিদ্র পিতা-মাতা তাদের অল্প বয়সি কন্যাসন্তানকে বিয়ে দিয়ে দেয়। তাদের ধারণা কন্যাকে বিয়ে দিলে তার অর্থাৎ কন্যার ভরণপোষণ নিশ্চিত হবে। ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে গিয়ে তারা তাদের সন্তানকে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।

এ ছাড়া গ্রাম বা এলাকার শিক্ষিত ও সচেতন জনগণও বাল্যবিবাহ রোধে তৎপর হচ্ছে না। কারণ গ্রামের মানুষের মধ্যে এখনো অনেক কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখনো মেয়েদের অবজ্ঞা ও অবহেলা করে। তারা মনে করেন, কন্যাসন্তান কখনোই স্বাবলম্বী হতে পারবে না। এ কারণে তাদের পড়াশোনা করানো মানে অর্থের অপচয়। গ্রামের কুসংস্কার আচ্ছন্ন মানুষ এখনো মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি এই বাক্যে বিশ্বাসী।

ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিবাহ রোধ করতে দেশের প্রান্তিক মানুষদের কুসংস্কার মুক্ত করতে হবে। দেশের সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে কঠোরভাবে সোচ্চার ও তৎপর হতে হবে। গ্রামাঞ্চলে বেশি বেশি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ সেমিনার, সভা ইত্যাদির আয়োজন করতে হবে। সেই সঙ্গে আইনি তৎপরতা আরো জোরদার করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সদস্য, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি ফিচার, কলাম অ্যান্ড কনটেন্ট রাইটার্স

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close