নূর মোহাম্মদ

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪

বিশ্লেষণ

মুমিন জীবনে সময়ের গুরুত্ব

‘সময়’ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অন্যতম নিয়ামত। আমাদের জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সময়। এটি মহান আল্লাহতায়ালার এমন একটা সৃষ্টি, যা সবার জন্য সত্য; সব সৃষ্ট বস্তুর নির্দিষ্ট সময় বা আয়ু রয়েছে। বিশ্বজগৎ এক দিন শেষ হয়ে যাবে; এর জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া আছে। সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত কোন সময়, কোন ঘটনা ঘটবে সবকিছু মহান আল্লাহ একটি নির্দিষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কিতাবুম মারকুম অর্থাৎ এটা লিপিবদ্ধ কিতাব।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ৯)

প্রত্যেক মানুষ দুনিয়ায় আগমন করেছে নির্দিষ্ট কিছু সময় নিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ের পর কোনো প্রাণী বা সৃষ্টির বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ্ কাউকেও অবকাশ দেবেন না।’ (সুরা মুনাফিকুন : ১১) এখন প্রশ্ন হলো, সময় কী? উত্তরে বলা যায় : যা এইমাত্র অতীত হলো- তাই সময়। এখন যে মুহূর্ত আমরা অতিক্রম করছি- সেটাই সময়। কিছুক্ষণ পরে যেখানে আমরা প্রবেশ করব- সেটাই সময়। এটি সর্বাবস্থায় চলমান। সময় নামের অক্টোপাস থেকে কে, কখন, কবে মুক্তি পেয়েছে বলুন?

আল্লাহতায়ালা সময়কে সৃষ্টির মধ্যে এমনভাবে স্থাপন করেছেন; যাতে মানুষ সময়ের গুরুত্ব দিতে শিখে। সফল তারাই, যারা এ সময়কে ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারেন। বিশেষত মুমিন জীবনে সময় মানেই নিজের মুক্তি ও পুরস্কার নিশ্চিত করে নেওয়ার মওকা। কারণ, দুনিয়ার জীবনের এই নির্দিষ্ট ও স্বল্প সময়ের ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী অনন্তকালের জীবনের পরিণতি। তাই একজন মুমিনের মালিকানায় থাকা সবচেয়ে দামি, মূল্যবান ও সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ এ সময়। অন্য সম্পদ হারিয়ে গেলে আবার ক্রয় করা যায়; কিন্তু সময় নামক এ সম্পদ হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না।

হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘হে আদম সন্তান! তুমি মুষ্টিমেয় কিছুদিনের সমষ্টি মাত্র। এক এক করে দিন যখন চলে যায়, তখন তোমার জীবনের একটা করে অংশ চলে যায়।’ (হিলইয়াতুল আওলিয়া) আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভী বলেন, ‘সময় একটি ধারালো তরবারি। যদি তুমি তাকে আটকাতে না পারো, তাহলে সে তোমাকে কেটে ফেলবে।’ (আল ওয়াকতু ফি হায়াতিল মুসলিম) এজন্য একজন মুমিন সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করবেন। সময়ের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘সময়ের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত! তবে তারা নয় যারা ইমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’ (সুরা আসর : ১-৩) এমনিভাবে আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে সুরা ফজর (দিনের প্রারম্ভ), সুরা লাইল (রাত), সুরা দোহা (সকাল), সুরা ফালাক (প্রভাত) ইত্যাদি নাজিল করে সময় সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘অধিকাংশ মানুষ দুটি নিয়ামত সম্পর্কে গাফেল তা হলো : সুস্থতা ও অবসর।’ (সহীহ বোখারি-৫৯৩৩)

সময়ের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য মহান আল্লাহ তার ইবাদতের মধ্যেও সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন; আর এটা অবশ্য কর্তব্য কাজের অন্তর্ভুক্ত। নির্দিষ্ট ইবাদতগুলো সময়ের আগে করাও জায়েজ নয়, আবার পরে করারও সুযোগ নেই। আল্লাহতায়ালা এর দ্বারা আমাদের বুঝিয়েছেন, কোনো কোনো কাজ তার নির্দিষ্ট সময়ের আগেও কবুল হবে না, পরেও না। যেমন সালাত সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মুমিনদের ওপর ফরজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।’ (সুরা নিসা : ১০৩) সাওম সম্পর্কে বলেন, ‘কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি (রমজান) পাবে, সে এ মাসে রোজা রাখবে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫) হজ সম্পর্কে বলেন, ‘হজে কয়েকটি মাস আছে সুবিদিত।’ (সুরা বাকারা : ১৯৭) জাকাত সম্পর্কে বলেন, ‘এর (উশর) অংশ ফসল সংগ্রহের দিন পরিশোধ করে দাও।’ (সুরা আনআম : ১৪১) এজন্য কল্যাণ লাভ ও সফল হতে হলে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কাজে মনোনিবেশ করতে হবে, গুরুত্বপূর্ণ কাজকে গুরুত্বহীন কাজের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে, উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত কাজ করতে হবে এবং মর্যাদাময় সময়ে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে।

হজরত আবু বকর (রা.) হজরত উমর (রা.)-কে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার সময় উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘শোনো! দিনে আল্লাহর কিছু কাজ রয়েছে, যা রাতে কবুল হবে না, আর রাতে কিছু কাজ রয়েছে, যা দিনে কবুল হবে না।’ (আল-ওয়াকতু ফি হায়াতিল মুসলিম) তাই তো মুসলিম স্কলাররা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে দিনের সময় ওজনের ‘দাঁড়িপাল্লা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা জুমাকে সপ্তাহের, রমজানকে বছরের এবং হজকে জীবনের দাঁড়িপাল্লা গণ্য করতেন। তারা চাইতেন- মানুষ দিনের কাজ দিনে শেষ করুক, সপ্তাহের কাজ সপ্তাহে, মাসের কাজ মাসে এভাবে পুরো জীবনকে কাজে লাগাবে। কারণ, সময় কারো জন্য বসে থাকে না, ফিরেও আসে না। হাসান বসরি (রহ.) চমৎকারভাবে বলেছেন, ‘ফজর ভেদ করে আলোতে আসা প্রতিটি দিন ডেকে বলে : হে আদম সন্তান! আমি এক নতুন সৃষ্টি। আমি তোমার কাজের ব্যাপারে সাক্ষী। আমার নিকট থেকে রসদ সংগ্রহ করো। কারণ, আমি বিদায় নেওয়ার পর কিয়ামত পর্যন্ত আর কখনোই ফিরে আসব না।’ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন বিবেকবান মানুষের চার ধরনের সময় থাকা উচিত : (ক) একটা সময় গোপনে রবের কাছে প্রার্থনা করবে, (খ) একটা সময় সে নিজেকে মূল্যায়ন করবে, (গ) একটা সময় আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করবে এবং (ঘ) একটা সময় খাবার ও পানীয় সংগ্রহের জন্য ব্যয় করবে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান)

সময়ের গুরুত্ব এত বেশি যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সময়ের বিষয়ে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে। কিয়ামতের দিন যে চারটি প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া পর্যন্ত বান্দার পা বিন্দু পরিমাণ নড়বে না; তার প্রথম দুটিই সময় সম্পর্কে। জীবন সম্পর্কে; তা কোন কাজে ব্যয় করেছে। যৌবন সম্পর্কে; কীভাবে তা ক্ষয় করেছে। সময়ের স্রষ্টা আল্লাহতায়ালা মহাহিসাবের দিন আমাদের এ পৃথিবীর প্রত্যেকটি দিনের হিসাব নেবেন। হিসাব দিতে হবে প্রতিটি শব্দের, প্রতিটি বাক্যের; তিনি বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার কাছেই রয়েছে।’ (সুরা কাফ : ১৮) বলা হবে তুমি তোমার সময়ের হিসাব দাও। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পাঠ করো তুমি তোমার আমলনামা! আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্য তুমিই যথেষ্ট।’ (সুরা বনী ইসরাইল : ১৪) হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঁচটি জিনিসের পূর্বে যে পাঁচটি জিনিসকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন, তার মধ্যে একটি হলো- ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে।

তেমনিভাবে, যারা দুনিয়াতে সময়কে গুরুত্ব দেয়নি, আল্লাহর দেওয়া নির্ধারিত সময়ে আমলে সালেহের মাধ্যমে পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করেনি; কিয়ামতের দিন তারা আর্তনাদ করে কিছু সময় চাইবে! কিন্তু তাদের কোনো সময় দেওয়া হবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবে : হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এখান থেকে বের করুন। এত দিন আমরা যে আমল করেছি, তার পরিবর্তে আমরা এখন নেক আমল করব। আল্লাহতায়ালা বলবেন : আমি কি তোমাদের এত দীর্ঘ জীবন দান করিনি যে, তখন কেউ সতর্ক হতে চাইলে সতর্ক হতে পারত? তোমাদের কাছে তো সতর্ককারীরাও এসেছিল।’ (সুরা ফাতির : ৩৭) তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো সময়ের প্রতিটা অংশকে কোনো না কোনো উপকারী কাজে ব্যয় করা, দুনিয়ার ব্যস্ততার মাঝেও পরকালীন পাথেয় সংগ্রহ করা, আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করা, কোরআন তিলাওয়াত করা, কল্যাণকর জ্ঞানার্জন করা। অবসর সময়ে ব্যস্ততার সময়ের মূল্যায়ন করা। অবসর সময়কে গণিমত মনে করে কাজে লাগানো; যেন সময়ের ক্ষুদ্র মুহূর্তও বিফলে না যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদিস থেকেও আমরা এ নির্দেশনা পাই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদি কিয়ামত এসে উপস্থিত হয় আর তোমাদের কারো হাতে একটা গাছের চারাও থাকে, তোমরা সুযোগ পেলে তা রোপণ করো।’ (মুসনাদে আহমদ) তাই আর নয় সময় অপচয়, সময়ের কাজ সময়ে করি, তবেই সময় হয়ে উঠবে আলোকময়, আমাদের জীবন ভরে উঠবে সোনালি সাফল্যের মোড়কে, হবে যথার্থ এবং কল্যাণকর।

লেখক : প্রভাষক (ইসলাম শিক্ষা), বলাখাল মকবুল আহমেদ ডিগ্রি কলেজ

হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close