অলোক আচার্য

  ০৫ জুন, ২০২৩

পরিবেশ ভাবনা

গহের আলীরা প্রকৃতিকে বাঁচাতে যুদ্ধ করেন, আমরা ধ্বংস করি

সবাই যে পরিবেশ ধ্বংস করছে এ কথা পুরোপুরি সঠিক না। এই পৃথিবীর বিষাক্ত বাতাস সুস্থ করতে অনেকেই প্রচেষ্টা করছেন। তারা নিয়মিতভাবে গাছ লাগিয়ে আসছেন। কেউ কেউ নিজের সবটুকু বিক্রি করেও পরিবেশ রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভিক্ষুক গহের আলীর কথা। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের দুই পাশে হাজার হাজার তালগাছ লাগিয়েছেন। এ রকম গহের আলী আমাদের দেশে আরো আছেন। আরো একজন হলেন ঠাকুরগাঁওয়ের ৮০ বছর বয়সের বৃদ্ধ খোরশেদ আলম। তিনি তার জমি বিক্রি করে নিজের গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলার রাস্তার পাশে তালগাছ বুনে চলেছেন। তাকে কোনোভাবেই থামানো যায়নি। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী তিনি ইতিমধ্যে প্রায় ৬০ হাজার তালগাছের চারা রোপণ করেছেন।

কিন্তু এই যে গহের আলীরা এটা করছেন তারা কিন্তু পরিবেশ দূষণ করছেন না। পরিবেশ দূষণ করছেন এই সমাজের বড়তলার মানুষগুলো। কিন্তু দিনশেষে প্রকৃতি গহের আলীদেরই মনে রাখবে। আর আমাদের অভিশাপ দেবে। গহের আলীদের পেশায় কিছু যায় আসে না। তার কর্মই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। অথচ লক্ষ করলে দেখা যাবে, আমরা যারা বড় বড় ব্যবসা করি, চাকরি করি তারা কারণে-অকারণেই গাছ কাটি। বিপরীতে একটি গাছও লাগাই না। যেকোনো স্থানেই উন্নয়নের প্রথম বলি হয় গাছ। অথচ এসব গাছেরও জীবন আছে। তাদেরও কষ্ট হয়। মরে যাওয়ার অনুভূতি আছে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু এ কথা বহু আগেই প্রমাণ করেছেন।

গাছ কেটে আমরা অথবা এই শিল্পনির্ভর বিশ্ব যে মহাভুল করছে সে কথা স্বীকার করলেও সেখান থেকে বাঁচার পথ না খুঁজে ফের গাছ কাটাতেই ব্যস্ত আছে। যার ফল পাচ্ছি হাতে-নাতে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে আর এর ফলে কী হতে পারে সেটাও আমরা জানি। এই তো কয়েক দিন আগেই খবরে দেখেছি নিউইয়র্ক শহর পানিতে ডুবে যাওয়ার খবর। এ রকম বেখবর আরো আছে। আমাদের মতো নিচু দেশগুলোর ভবিষ্যৎও একই রকম। বিবিসি নিউজ বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, অতি উত্তপ্ত এই বিশ্ব আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৬ শতাংশ।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন বহুমুখী। অর্থাৎ জলবায়ুর কারণে আমাদের ক্ষতির বোঝা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জিওগ্রাফির একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রবল গরম ও খরার মুখোমুখি হতে চলেছে বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ। নেচার সাসটেইনেবিলিটি পত্রিকায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবল উষ্ণায়ন ও স্থলভাগে পানির সংকট- এ দুই কারণে পৃথিবীজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দশ গুণ বাড়বে। কার্বন নিঃসরণও সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকবে। এসব কারণে অর্থনীতিও প্রভাবিত হবে। ধনীরা আরো ধনী হবে এবং গরিব আরো গরিব হবে। খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে এ পরিস্থিতি।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, খরাবিধ্বস্ত হর্ন অব আফ্রিকায় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ২২ মিলিয়ন পৌঁছেছে। কেনিয়া, সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়ায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ খরার মুখে পড়েছে। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনবিষয়ক দপ্তর (ইউএনডিআরআর) বলছে, চলতি দশক অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টি, যা দৈনিক গড়ে দুটির কাছাকাছি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ দুই দশকে প্রতি বছর ৩৫০ থেকে ৫০০টি মধ্যম থেকে ভয়াবহ দুর্যোগের শিকার হয়েছে বিশ্ববাসী। এটি আগের তিন দশকের গড় দুর্যোগের তুলনায় পাঁচ গুণের বেশি।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশ বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। শিল্পযুগ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর আবহমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। পৃথিবী নামক এই গ্রহটির ধ্বংস হওয়ার সম্ভাব্য দুটি কারণ রয়েছে। এর দুটি কারণই মানবসৃষ্ট। একটি হলো যুদ্ধ এবং অপরটি হলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এমনকি বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি ঘটছে, মানুষের সম্পদের বিনষ্ট ঘটছে, স্থানচ্যুতি ঘটছে এবং জীবিকার পরিবর্তনের মানুষের জীবনযাপনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বজ্রপাতের মৌসুমেও বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যেই তীব্র গরম আবহাওয়া বদলানো ইঙ্গিত দিচ্ছে। কয়েক দিন আগেই ‘মোখা’ আঘাত করেছে। এরপর আরো একটি ঘূর্ণিঝড়ের কথা শোনা যাচ্ছে। এভাবে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রেশ শেষ কাটতে না কাটতে আরো একটি দুর্যোগ আঘাত করছে। প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও যে ক্ষয়ক্ষতি হয় সেটাও কম নয়। এমনকি এশিয়া জুড়েই তীব্র তাপপ্রবাহ লক্ষ করা যাচ্ছে। গত এপ্রিলে চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলে মৌসুমি তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মে মাসের শেষ দিকে তাপমাত্রা আরো বেড়ে যায়। ভিয়েতনামের তাপপ্রবাহ জুন পর্যন্ত স্থায়ী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও এপ্রিল মাসে ৫০ বছরের মধ্যে উষ্ণতম দিন ছিল। এ ছাড়া থাইল্যান্ডে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল, যা দেশটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। সিঙ্গাপুরেরও একই অবস্থা। অর্থাৎ তীব্র তাপপ্রবাহ এশিয়া জুড়েই।

প্রকৃতির এই রুদ্র আচরণ অপ্রত্যাশিত নয়। ভূমণ্ডল উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে এমন ধারণা আজকের নয়। বিজ্ঞানীরা কয়েক দশক ধরেই এমন হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। আবহাওয়ার চরিত্র দীর্ঘ অনেক বছর যাবৎ বদলাচ্ছে। বিশ্বের বেশি মাত্রায় কার্বন নিঃস্মরণকারী দেশ হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আমরা মূলত এ রকম বড় শিল্পোন্নত দেশের কার্বন উৎপাদনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার। তার সঙ্গে রয়েছে নিজেদের ভারসাম্যহীনতা। সব মিলিয়ে অবস্থা যে ভজঘট সেটা বোঝা যায়। আমরা পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু তাই বলে বসে থাকার কোনো উপায় নেই। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে আমরা বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলেছি। কিন্তু আমাদের আরো শক্ত প্রস্তুতি থাকতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ২০১৫ সালে সম্পাদিত বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। এতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো আশাবাদী ছিল যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোকে আমরা পাশে পাব। যদিও এই জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের দায় তুলনামূলকভাবে কম কিন্তু ফল ভোগ করছি আমরাই বেশি। বিশ্বের ১৮০টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা। যে অর্থ ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশগুলোর একটি। প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত হচ্ছে অগণিত মানুষ। সেসব মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে চাপ বাড়ছে শহরের ওপর। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, কালবৈশাখী, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডোসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শহরের ওপর চাপ বাড়ছে। ভিক্ষাবৃত্তি বাড়ছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছি আমরা। যদি তা হয় তাহলে আমাদের দেশের একটা অংশ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু আমাদের দেশ নয়। এ রকম নিচু বহুদেশ সমুদ্রগর্ভে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ অবস্থা থেকে বাঁচতে আমাদের প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। আর প্রকৃতি বাঁচাতে প্রচুর প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে। যে বিপুলসংখ্যক গাছ প্রতিদিন আমাদের প্রকৃতি থেকে

কাটা হচ্ছে তার চেয়ে খুবই কমসংখ্যক গাছ লাগানো হচ্ছে। যারা প্রকৃতিকে বাঁচানোর কাজটি করছেন তারা হলেন এই গহের আলী বা খোরশেদ আলমের মতো মহান মানুষ। আর যারা

মহানের বেশ ধরে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছেন তারা যত দিন না প্রকৃতিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন তত দিন প্রকৃতিকে সবুজে ফেরানো সম্ভব নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close