সাধন সরকার

  ২৫ মার্চ, ২০২৩

মুক্তমত

মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ সময়ের দাবি

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর মেরুদণ্ড সোজা না থাকলে একজন মানুষ যেমন দাঁড়াতে পারে না, তেমনি মাধ্যমিক শিক্ষা মানসম্মত না হলে তা জাতির জন্য অশনিসংকেত বটে। মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষা বিস্তারে এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কেননা মাধ্যমিকপর্যায়ে ৯৪ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। মাধ্যমিকের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সরকারি শিক্ষকদের মতো বেতন-ভাতা পান না। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা মূল বেতনের (বিএড ডিগ্রি থাকলে ১০ গ্রেড, বিএড ডিগ্রি না থাকলে ১১ গ্রেড) সঙ্গে অন্যান্য যৎসামান্য ভাতা (বাড়িভাড়া নির্দিষ্ট ১ হাজার ও চিকিৎসা-ভাতা ৫০০) পান। অন্যদিকে সরকারি শিক্ষকরা যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পান। ফলে প্রায় সময় দেখা যায় বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষকতা পেশা সমাপ্ত করে একজন শিক্ষককে টাকার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। অনেক শিক্ষককে টাকার অভাবে রোগেশোকে মারাও যেতে দেখা যায়। এমনটি মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান।

শিক্ষকের বেতন-ভাতা কম বলে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। অন্য পেশায় চলে যান। মাধ্যমিকপর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকতা পেশায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য দৃশ্যমান। মনে রাখা দরকার, শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গে মানসম্মত সম্মানীও দরকার। এমপিওভুক্ত একজন শিক্ষককে চাকরি জীবন শেষে অবসর-কল্যাণ সুবিধার টাকা পেতেও বছরের পর বছর বসে থাকতে হয়। তাই মাধ্যমিকপর্যায়ে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ যৌক্তিক দাবি।

বর্তমানে উপজেলাপর্যায়ে একটি মাত্র মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় নগণ্য। দেখা যাচ্ছে, ঢাকা বা বিভাগীয় শহরগুলোতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী মাসিক এক শ টাকার কম বেতনে পড়াশোনা করছে। অন্যদিকে উপজেলা বা গ্রামপর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী সরকারি বিদ্যালয়ের বেতনের তিন-পাঁচ গুণ টাকা দিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে। ক্ষেত্রবিশেষে স্বল্প আয়ের অভিভাবকরা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ‘ফি’র কারণে তাদের সন্তানদের পড়াতে পারছে না! এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন শিক্ষক, পাঠ্যবই, অবকাঠামো, শিক্ষকদের বেতন সবই দিচ্ছে সরকার। তাহলে প্রশ্ন জাগে, সবই যখন দিচ্ছে সরকার তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বেসরকারি? বর্তমানে একটা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন খাতে আয়-রোজগারও নেহাত কম না। তা ছাড়া জাতীয়করণ করা হলে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে।

এখন একটা গবেষণা করা দরকার যে, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করলে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ শিক্ষকদের বেতন-ভাতার জন্য অতিরিক্ত প্রয়োজন হবে। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমানো অর্থ আর মাসিক আয়-রোজগারের অর্থ দিয়ে দেওয়ার পরও খুব একটা অর্থ লাগার কথা না। মূলত পৃথিবীর বেশির ভাগ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ মনে করে শিক্ষায় বিনিয়োগ বা ব্যয় সবচেয়ে উত্তম বিনিয়োগ। শিক্ষকের জীবনে যদি অর্থকষ্ট থাকে তাহলে শিক্ষক কীভাবে আনন্দের সঙ্গে পাঠদান করবেন? শিক্ষক যদি স্বপ্ন না দেখেন তাহলে শিক্ষার্থীদের কীভাবে আলোকিত করবেন? সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের বেলায় একই যোগ্যতা ও মানদণ্ড নির্ধারণ করা হলে বেতনের বেলায় কেন বৈষম্য থাকবে? একই কারিকুলাম ও সিলেবাসে পাঠদান হলে বেতনের বেলায় কেন বৈষম্য? অনেককে বলতে শোনা যায়, মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হলে শিক্ষার মান পড়ে যাবে! এটা নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত ও ভিত্তিহীন কথা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন। তখন শিক্ষার মান কি পড়ে গিয়েছিল? অবশ্যই না। বরং মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে সেটাই ছিল যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ অথবা জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো তা থেকে অনেক দূরে। বিগত কয়েক বছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের বাজেট থাকে প্রায় ২ শতাংশ (প্রযুক্তি খাত বাদে)। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দিকে যখন তাকাই, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল সবাই শিক্ষার উন্নয়নে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বরাদ্দ দিয়ে থাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ১৯৭২ সালে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়, যার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের জন্য ছিল ২২ শতাংশ (১৭৩ কোটি টাকা)। দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা পরিবার এমপিওভুক্ত ৫ লাখেরও বেশি শিক্ষকের প্রাণের দাবি মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষার বিকল্প নেই। দেশের সেরা মেধাবীদের যথাযথ সম্মান ও সম্মানী দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হলে গ্রাম-শহরপর্যায়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য যেমন কমবে, তেমনি সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেশের ভবিষ্যৎ সুনাগরিক সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে যাবে। সব মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একবারে না হলেও ধাপে ধাপে নির্দিষ্ট মানদণ্ড মেনে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয়করণ করা দরকার। মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ সময়ের দাবি।

লেখক : শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close