অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

  ১৮ মার্চ, ২০২৩

মতামত

চালকদের মাদকমুক্ত থাকতে হবে

গত এক দশকে বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করেছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে। ফলে দেশে বেশ কিছু প্রশস্ত সড়ক, মহাসড়ক ও সেতু বিশ্বমান বজায় রেখে নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়া পুরাতন অনেক সড়ক ও মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং কিছুর কাজ চলমান রয়েছে। মহাসড়কের মধ্যে ২০১৬ সালে গৃহীত ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেনের মহাসড়ক অন্যতম।

সেতুর মধ্যে অবশ্যই পদ্মা সেতুর কথা সবার আগে বলতে হয়। এ সেতু নির্মাণে সংশয় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বে সরকার নিজ দেশের জনগণের অর্থে এই সেতু নির্মাণ করেছে। এটি একটি দুঃসাহিক ও সফল কাজ। এ ছাড়া আরো অনেক সেতু ও প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ ও মেরামতের মাধ্যমে সারা দেশের সড়ক যাতায়াত ব্যবস্থাকে দ্রুতগতি সম্পন্ন করেছে। এটি সর্বজন স্বীকৃত যে, সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক যাতায়াতে সরকার ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং জনগণ এর সুফল পেয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি বাস্তবতার নিরিখে দেখা প্রয়োজন। আধুনিক সড়ক ও সেতু হয়েছে, তবে সড়ক দুর্ঘটনাও কমছে না। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে অকাল পঙ্গুত্ব ও মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। এটা ভালো কথা নয়। সড়কে মৃত্যু না কমে আরো বেড়েই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়টি সবারই আরো গভীর মনোযোগের দাবি রাখে। করোনা মহামারির সময়েও সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। সরকারি হিসাব মতে, ২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে হয় প্রায় ৩০ শতাংশ।

বিআরটিএর হিসাবে প্রতিদিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ জন প্রাণ হারান। সে হিসাবে বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার ৮০০ জন। তবে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বিষয়ে বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলছে, এ সংখ্যা ১২ হাজার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সেটা ২০ হাজার। বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন। এসব কারণের মধ্যে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং, জরাজীর্ণ সড়ক, অযোগ্য যানবাহন, অদক্ষ চালক, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন বা হেডফোন ব্যবহার এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব অন্যতম। এ ছাড়া আরো কিছু কারণের কথা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে জানা যায়। চালকদের দীর্ঘসময় গাড়ি চালানো ও ট্রিপকেন্দ্রিক গাড়ি চালানোর বিষয়টিও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

আমি গত ৪০ বছর দেশে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এর মধ্যে, মাদক ও ধূমপানবিরোধী কার্যক্রম অন্যতম। আমি মনে করি, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাদক ও তামাকের নেশা শুধু মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নানান সমস্যা তৈরি করে। সামাজিক কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে দেখেছি, মাদক ও ধূমপানের নেশা মানুষের চালকদের মনস্তত্বে প্রভাব ফলে। যেকোনো নেশা মানুষকে তাৎক্ষণিক উত্তেজিত করলেও ক্রমান্বয়ে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে।

চালকদের মধ্যে মাদকাসক্তি কিংবা ধূমপান ও তামাকে আসক্তি নিয়ে দেশে সুনির্দিষ্ট গবেষণা নেই। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ঢাকায় কমপক্ষে ৫০ হাজার গণপরিবহন চালক ও তাদের সহকারীরা মাদকাসক্ত। ক্রমাগত ক্লান্তি ও বিষণ্নতায় বেশির ভাগ চালক ও চালকের সহকারীরা (হেলপার/কন্ডাক্টর) ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য সেবন করে থাকে। বিষয়টি পরিবহন মালিকসহ সংশ্লিষ্টরাও স্বীকার করেছেন।

বাংলাদেশ পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত ১৯৯৮-২০১৪ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট জানায়, দেশে প্রায় ১০ শতাংশ চালক মাদকদ্রব্য সেবন করে। আলোচিত বিষয় ‘গণপরিবহনে নারীদের প্রতি সহিংসতা ও হয়রানির ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে ড্রাইভার ও সহকারীদের মাদকাসক্তিকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মাদকাসক্তি বর্তমানে চালকসহ ও পরিবহন সেক্টরের একটি শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে একটি সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পরিবহন সেক্টরের নেতারাও বিষয়টি মেনে নিয়ে এর সমাধানে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নতি চোখে পড়েনি।

মাদকের সঙ্গে ধূমপান ও তামাকের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বলা যায়, এ বিষয়টি সবস্তরেই পরিষ্কার। ধূমপান ও তামাকে আসক্ত ড্রাইভারদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বেশি লক্ষ করা গেছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে, গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়ায় যাত্রীসাধারণ বর্তমানে বাসের ভেতরে ধূমপান করেন না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসগুলো ছাড়া অধিকাংশ সিটি সার্ভিস ও আন্তনগর বাসে প্রায়ই চালক ও তাদের সহকারীদের ধূমপান করতে দেখা যায়।

আমি ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে যাতায়াতের সময় লক্ষ করি, বাসে চালকদের অনেকের হাতে সিগারেট থাকে। বাসে সিগারেট খাওয়া অর্থাৎ ধূমপান করার বিষয়টি একেবারেই অনৈতিক। এতে অনেক আইনের লঙ্ঘন হয়। যাত্রীসাধারণ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। বিশেষ করে, বাসে নারী ও শিশুরা যেখানে বসে তার পাশেই চালক ও সহকারীরা ধূমপান করে। এতে শিশু ও নারীরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়।

তার চেয়েও বড় কথা, চলন্ত গাড়িতে সিগারেট ধরানোর জন্য দু-হাতের ব্যবহার করতে হয়। অল্প সময়ের মনোযোগে এই বিচ্যুতি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। এ ছাড়া সিগারেটটি জ্বালানোর পর এক হাতে যখন সিগারেট থাকে, বারবার সিগারেটকে ঠোঁটের কাছে নিতে হয়। জানালা দিয়ে মুখ বের করে ধোঁয়া ছাড়তে দেখা যায়। তখন স্বাভাবিকভাবেই নেশার দিকে মনোযোগ যায়। এটিও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।

চালকদের আচরণগত এ সমস্যা সার্বিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনাকে প্রকট করে তুলছে। অর্থাৎ চালকদের মধ্যে মাদকদ্রব্য ও অন্যান্য ক্ষতিকর নেশাজাত দ্রব্য সেবনকে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে গুরুতর কারণ হিসেবে দেখছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্য-মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, দেশে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ। বিশেষ করে, বাসের মতো গণপরিবহন শতভাগ ধূমপানমুক্ত। এ ছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিএ) সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২ অনুমোদিত হয়েছে। এই বিধিমালার তফসিল-২ ও ৩-এ গণপরিবহনের চালক, কন্ডাক্টর ও সুপারভাইজারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অংশে ধূমপান এবং এলকোহল বা অন্য কোনো মাদকের নেশা থেকে বিরত থাকার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটি বিআরটির অন্যতম একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এখন সিদ্ধান্তের কার্যকর বাস্তবায়ন করাটা জরুরি।

‘বেপরোয়া ড্রাইভিং’ বাংলাদেশে সড়কে প্রাণহানির প্রধান কারণ এবং এই বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের জন্য প্রধানত মাদকাসক্তিকে দায়ী করা হয়। চালকদের মধ্যে মাদকাসক্তি প্রতিরোধে ডোপ টেস্টের উদ্যোগ নিয়েছে বিআরটিএ। এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে গেলেও লাগবে ডোপ টেস্ট। ৩০ জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডোপ টেস্ট ছাড়া কোনো পেশাদার চালককে আর লাইসেন্স না দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং সময়োপযোগী একটি উদ্যোগ। ডোপ টেস্ট সারা দেশে সব পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে এবং ঢাকা মহানগরীর ক্ষেত্রে ছয়টি প্রতিষ্ঠানে (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল) করা যাবে বলে বিআরটিএ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল। ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চালকদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করার যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন; সেটার একটি ধাপ বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে তা ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি, লোকবল সংকটসহ অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। সীমাবদ্ধতা আছে পুলিশ বাহিনীতেও। বিশেষ করে শনাক্তকরণ মেশিন না থাকায় পুলিশ মাদক সেবনকারীদের শনাক্ত করতে পারে না। এ ছাড়া শনাক্তকরণ কার্যক্রম পরিচালনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ জনবল নেই।

মাদকাসক্ত চালকদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ সড়ক যাত্রীর জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি চালকের জন্যও প্রয়োজন। সড়কে যত্রতত্র রাস্তা পারাপারের বিষয়টি বন্ধ করতে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সঠিক ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। সড়ক ও যোগাযোগমন্ত্রীও অত্যন্ত আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। এ বিষয়ে সংসদে আইন পাস হয়েছে। এখন সেটার যথার্থ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমিক, মালিক, যাত্রী সাধারণ সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে পেশাদার চালকদের দক্ষতা উন্নয়ন ও তাদের মাদক ও ক্ষতিকর নেশামুক্ত করতে হবে। সড়কে মানুষের জীবনের সুরক্ষায় কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়া উচিত হবে না। তাদের ডোপ টেস্টের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া ট্রাফিক নিয়মাবলি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এজন্য সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী, গণমাধ্যমে প্রচারণা ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও জনসাধারণের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে হবে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে সবার সমন্বিত উদ্যোগ এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অপরিহার্য। সংশ্লিষ্ট সবাই সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে যত্নবান ও দায়িত্বশীল হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে আমি আশাবাদী।

লেখক : চিকিৎসক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close