আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

সমকালীন প্রসঙ্গ

জলবায়ু শরণার্থী ও বাংলাদেশ

একুশ শতকের সবচেয়ে বড় সমস্যার একটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব যেমন- স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়া, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূলের বাড়িঘর ও জমিজমা তলিয়ে যাওয়া, নদণ্ডনদী ও খাল-বিলের পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে মানবসমাজ এখন এক জলবায়ু সংকটকাল অতিক্রম করছে। এই সংকটের কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও বিপুলসংখ্যক মানুষ পরিণত হচ্ছে জলবায়ু শরণার্থীতে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিরূপ পরিস্থিতির কারণে কোনো স্থানের মানুষ যখন নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাস করতে বাধ্য হয়, তখন তাদের বলা হয় জলবায়ু শরণার্থী।

ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইএমডিসি) তথ্য মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় সাত লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুত ঘটে। সাম্প্রতিককালে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় যেমন- সিডর, আইলা, নার্গিস, মহাসেন, ফণা, আম্পান, সিত্রাং ইত্যাদির মতো দুর্যোগের কারণে এই সংখ্যা আরো বেড়ে গেছে। আইডিএমসি আরো জানিয়েছে, ২০১৯ সালে যে পাঁচটি দেশে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত ঘটেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ২০৫০ সালে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হতে পারে আনুমানিক ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ। উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে ঠাঁই নিচ্ছে শহরে, বিশেষ করে ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরের বস্তি এলাকাতে। ফলে দ্রুত বর্ধনশীল ও বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির ঢাকা শহর দিন দিন আরো ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠছে। মনে করা হয়, ঢাকা হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। এখানে সমস্যার শেষ নেই। বিপুলসংখ্যক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ঢাকায় নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। সম্প্রতি ‘ইকোনমিকস ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ কর্তৃক প্রকাশিত দ্য গ্লোবাল লিভেবিলিটি সূচক ২০২২ অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৬তম। এ থেকে সহজেই অনুমেয় ঢাকার বসবাসযোগ্যতা কোন পর্যায়ে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ জলবায়ু শরণার্থীদের শহরমুখী হওয়া ফেরাতে না পারলে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের বসবাসযোগ্যতার সূচক আরো নিচে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।

জলবায়ু শরণার্থী সংকট সমাধানকল্পে এলাকাভিত্তিক চিন্তা করতে হবে। লোকজ প্রথা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানো যেতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জানমাল রক্ষায় দেশের উপকূল ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় স্থায়ী পাকা বাড়ি নির্মাণ না করে এমন বাড়ি নির্মাণ করা যেতে পারে, যেন জরুরি অবস্থায় স্থান পরিবর্তন করা সম্ভব হয়। এছাড়া স্থানীয়ভাবে উপযোগী বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, ক্লাস্টার ভিলেজ, বসতভিটা উঁচুকরণ প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে।

নদীভাঙনে প্রতি বছর উত্তর জনপদে- তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অঞ্চল অন্ততপক্ষে ১০ হাজার পরিবার বসতভিটা হারাচ্ছে। নদীভাঙনের শিকার মানুষজন কৃষিজমি কিনে বাড়িঘর স্থাপন করছে, যাতে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। নদীভাঙনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তরিত হওয়ায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। বর্তমানে চরাঞ্চলে শিক্ষাবঞ্চিত শিশু ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে নদীভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ করে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে পলি জমে নদী নিজ থেকেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আবাদি জমি বালু পড়ে অনাবাদি হয়ে পড়ছে। দখল-দূষণ তো আছেই, সব মিলিয়ে উত্তরাঞ্চলের ২১০টি নদীর মধ্যে মাত্র ১৮টি কোনোমতে বেঁচে আছে। এর প্রভাব পড়ছে নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর। জেলেদের জীবিকা নষ্ট হচ্ছে। নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করা যাচ্ছে না।

নদীপাড় রক্ষায় কংক্রিটের ব্লকের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ করা, বিশেষ করে বাঁশ লাগানো যেতে পারে। বাঁশ অধিক পরিমাণে মাটি ধরে রাখে। বাঁশের তেমন পরিচর্যারও দরকার হয় না। এভাবে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান করা যেতে পারে। তবে এসব কাজে স্থানীয় কমিউনিটির লোকজনকে সঙ্গে নিলে টেকসই হবে। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৭০ শতাংশ মানুষ স্থানীয় কর্ম হারিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাময়িকভাবে কাজের সন্ধানে যাচ্ছে। অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে মাইগ্রেন্ট লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। লবণাক্ততা বাড়ার ফলে দক্ষিণাঞ্চলে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। অনাবৃষ্টির ফলে ফসলি জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জলবায়ুসহিষ্ণু কৃষি চাষাবাদের জন্য অধিক গবেষণা করা ও প্রণোদনা দেওয়া উচিত। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নপূর্বক তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে এসব এলাকার মানুষজনকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি অনলাইন মার্কেটিং, ই-কমার্স ইত্যাদির প্রচলন চালু করতে হবে। চরাঞ্চলে পণ্য সংরক্ষণাগার তৈরি করতে হবে, যেন কৃষক দুর্যোগকালীন ক্ষতির সম্মুখীন না হন।

অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশ প্রতি বছরই উন্নত বিশ্বের কাছে ফান্ড চেয়ে থাকে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে জলবায়ু সহনশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে ইউএনএফসিসি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ২০১০ সালে (কপ-১৬) গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড গঠন করে। ২০২২ সালে মিসরে কপ-২৭ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার দেশগুলোকে সহায়তা দিতে লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠনে সম্মতি দেয় ১৯৮টি দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা কমাতে এই ফান্ডকে কাজে লাগাতে হবে।

জলবায়ু শরণার্থী সংকট সমাধানকল্পে বাংলাদেশ সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন- ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ২০২১, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান, ডেলটা প্ল্যান, ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান ইত্যাদি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট উত্তরণে সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান

পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close