আখতার হোসেন আজাদ

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবসে প্রস্তাবনা

বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস পালিত হচ্ছে প্রতি বছরের ৫ ডিসেম্বর। ১৯৮৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের অধিবেশনে সারা বিশ্বে স্বেচ্ছাসেবীদের অবদানের কথা সর্বত্র তুলে ধরা, যেকোনো দুর্যোগে মানবিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলা এবং স্বেচ্ছাসেবার গুরুত্ব তুলে ধরে নাগরিকদের স্বেচ্ছাসেবায় আগ্রহী করে তোলার উদ্দেশ্যে এ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সমাজে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের একে অপরের সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন। মানুষ সর্বদা অন্যকে সহযোগিতা করতে চায়। এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তবে একা সহযোগিতা করার চেয়ে কয়েকজন সমমনা ব্যক্তি একত্রিত হয়ে যখন কোনো কাজ করে তখন তা অতীব সহজ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে মহামারি করোনাভাইরাসের থাবায় সারা বিশ্ব যখন আক্রান্ত, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যখন ব্যাহত, মানবতার সেবায় বিশ্বব্যাপী উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে স্বেচ্ছাসেবকরা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

করোনায় কাজ হারানো দুস্থ-অসহায় পরিবারের আলোকবর্তিকা হয়ে জীবনবাজি রেখে কাজ করে গেছে দেশের স্বেচ্ছাসেবকরা। এছাড়াও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্রান্তিকালে ও নানাবিধ সচেতনতায় সৃষ্টিতে তারা কাজ করে যাচ্ছে। প্রকৃত কথা, স্বেচ্ছাসেবকদের নিঃস্বার্থ অবদানের কথা লিখে শেষ করা যাবে না।

বিভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সংঘবদ্ধ হয়ে মানুষ স্বেচ্ছায় বিভিন্ন ধরনের সংগঠন গড়ে তোলে। স্বেচ্ছায় রক্তদান, আর্থিক সহায়তা প্রদান, নিরক্ষরদের অক্ষরজ্ঞান প্রদান, গ্রামের কৃষকদের পরামর্শ প্রদানসহ বিভিন্ন সেবামূলক লক্ষ্যে নানা সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। সাধারণত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সামাজিক সংগঠনগুলোর ব্যাপক কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। তবে বর্তমান সময়ে দেশের বিভিন্ন গ্রাম, শহর, জেলা বা অঞ্চলকেন্দ্রিক নানা লক্ষ্যের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে উঠছে।

তরুণরা মানবতার সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে এটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশার দিক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এসব সংগঠনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য উপযুক্ত কর্মী বা সদস্য প্রয়োজন। একটি লক্ষ্যে কখনই পৌঁছানো সম্ভব নয়; যতক্ষণ না সে সংগঠনের সদস্যরা উক্ত সংগঠনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণরূপে দক্ষ ও পরিপূর্ণরূপে নিবেদিত করে। যদিও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবায় এগিয়ে আসে, তবুও এসব সংগঠনগুলোর সদস্যদের মাঝে কিছু বৈশিষ্ট্য কাম্য। নচেৎ এর উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় এবং গতিশীলতা হারিয়ে যায়। কোনো সংগঠনের সদস্যরা যদি উক্ত সংগঠনের গঠনতন্ত্র-নিয়মনীতি মেনে না চলেন, তবে সেই সংগঠন দ্রুতই খেই হারিয়ে ফেলে। পদের প্রতি লোভ হলো যেকোনো সংগঠনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টির অন্যতম ধাপ।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কেউ নেতা নয়। প্রত্যেকেই মানবতার সেবায় নিবেদিত প্রাণ। মনে রাখতে হবে, কেবল সাংগঠনিক গতিশীলতার জন্যই এসব পদবিন্যাসের সৃষ্টি। একটি সংগঠনের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হওয়ার জন্য স্বজনপ্রীতি বা আঞ্চলিকতা হলো আরেকটি কারণ। নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই গুণটি অনেক সময় অযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত করে। যার ফলে দলের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আর্থিক সচ্ছতা হলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সকল প্রকার আয়ের উৎস এবং ব্যয়ের খাতগুলোর পরিপূর্ণ হিসাব রাখা হলো দক্ষ সংগঠকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখানেই শেষ নয়। আর্থিক প্রতিবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সদস্যদের জানানো উচিত। এতে একে অপরের প্রতি অনাস্থা ও অবিশ্বাস কখনোই সৃষ্টি হবে না। অবিশ্বাস, সন্দেহপ্রবণতা, হিংসা, গিবতের ফলে যেকোনো সংগঠনের মাঝে ভালোবাসার বন্ধন নষ্ট হয়। লোক দেখানো বা পারস্পরিক সহযোগিতার বদলে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের হীন চেষ্টা করলে সংগঠনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

সামাজিক সংগঠনের নেতাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে নেতা মনে না করে সদস্যদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া উচিত। একজন দক্ষ সংগঠকের তার সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং সাংগঠনিক সুসম্পর্ক রাখা জরুরি। তবে এই সম্পর্ক যেন সংগঠনে স্বজনপ্রীতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। নিজেকে সর্বাভিজ্ঞ ভেবে যেকোনো বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেওয়া দুর্বল নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য। জ্ঞানের কোনো সীমা নেই। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তা সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে নিলে তাতে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে খুবই ক্ষীণ।

হুটহাট করে রাগ করা, সহকর্মীরা ভুল করলে চরমমূর্তি ধারণ করা বর্জনীয়। দক্ষ নেতার ধরেই নেবেন, তার সহযোদ্ধারা ভুল করবে। কারণ রাগের মাথায় মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুল করে। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মুখ দিয়ে অশালীন কথা বা গালি বের হয়ে যেতে পারে। এতে পরবর্তী সময়ে কোনো ভুল হলে অগ্নিরূপ থেকে রক্ষা পেতে সহকর্মীরা তা গোপন করতে চেষ্টা করবে। ফলে এসব থেকে বৃহত্তর ক্ষতির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। রাগ দমন করে প্রতিকূল পরিবেশে মেজাজ স্বাভাবিক রেখে ঠাণ্ডা মাথায় তা মোকাবিলা আদর্শ নেতার বৈশিষ্ট্য। সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের নেতৃত্বের প্রতি যেমন আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে, তেমনই নেতাদের উচিত সবার সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করা। তবেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন করে মানবতার সেবা নিশ্চিত সম্ভব হবে।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে নামে-বেনামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বিভিন্ন শাখা। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করে গড়ে উঠছে নানাবিধ সংগঠন। ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে পদের নাম উল্লেখ করে অভিনন্দন বার্তা গ্রহণ করেই যেন ঘটে এসব নাম সংগঠনের উদ্দেশ্যের সমাপ্তি। আবার সহযোগিতার নামে অর্থ আদায় এবং আর্থিক অনিয়মসহ নানাবিধ বিষয়ে অভিযোগ প্রায়ই ওঠে আসে কিছু সংগঠনের নামে। ফলে একদিকে যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন, তেমনি সামাজিক সংগঠনগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়ায়ও আনা প্রয়োজন। তবে এটিও উল্লেখ প্রয়োজন যেন নজরদারির নামে সংগঠনগুলোর কর্মপরিধি সীমিত করে তোলা না হয়।

আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক সহশিক্ষা কার্যক্রমকে সমর্থন করেন না পড়ালেখার ক্ষতির আশঙ্কায়। তবে এমন অহেতুক ধারণা ভাঙতে হবে। যদিও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান থেকে সামাজিক উন্নয়ন কাজে বিশেষ অবদান রাখার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের স্বীকৃতস্বরূপ বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়ে থাকে কিন্তু এটির মাত্রা বৃদ্ধি করতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বেচ্ছাসেবকদের মূল্যায়ন করতে হবে। এতে এক দিকে ভালো কাজের যেমন স্বীকৃতি মিলবে, অন্য দিকে অন্যরাও এতে উৎসাহী হবে। ‘তুমি ভালো, সে ভালো, আমি আরো ভালো হতে চাই’ এই মধুর প্রতিযোগিতা সমাজে সৃষ্টি হোক। ভালোর সঙ্গে ভালোর প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়ে প্রতিহিংসা নামক শব্দটি মুছে গিয়ে মানবতার জয় হোক আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবসে এটিই প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষার্থী

লোক প্রশাসন বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close