আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০২২

পরিবেশ

বায়ুদূষণ টেকসই উন্নয়নের অন্তরায়

প্রবাদ আছে : প্রবাহই জীবন। মানুষ যতক্ষণ বেঁচে থাকে, ততক্ষণই প্রয়োজনীয় বস্তুকে গ্রহণ করে, আবার অপ্রয়োজনীয় বস্তুকে ত্যাগ করে থাকে, যা তার জন্য আবশ্যক নয়, তা বর্জন করাই মানুষের প্রাণের ধর্ম। কিন্তু বিশুদ্ধ বায়ু ও পানি মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক বিধায় এই অধিকারকে আমরা অবহেলা করতে পারি না। বায়ুতে আণুবীক্ষণিক বস্তুকণার উপস্থিতিতে যে দূষণ ঘটে, তাকে বলা হয় ফাইন পল্যুশন পার্টিক্যালস টু পয়েন্ট ফাইভ বা পিএম ২.৫। বাতাসে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতির কারণে দীর্ঘমেয়াদি বায়ুদূষণের সংস্পর্শে থাকার ফলে পৃথিবীব্যাপী স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস, ফুসফুসের ক্যানসার, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগ ও বিভিন্ন ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিসঅর্ডার (সিওপিডি) রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর পৃথিবীব্যাপী মৃত্যু হয় ৬৭ লাখ মানুষের, তার মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার নবজাতক শিশু। বাতাসে কার্বন ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার মিশ্রনপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে, অতিসম্প্রতি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০২০ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। যদিও এর আগে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, পিএম ২.৫ দূষণজনিত কারণে প্রতি বছর বিশ্বে মৃত্যু হয় ৪২ লাখেরও বেশি মানুষের।

বাংলাদেশেও বায়ুদূষণ ভয়ংকর অবস্থায় পৌঁছে গেছে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার কোনো এলাকায়ই নির্মল বায়ুর খোঁজ পাওয়া যায় না। ঢাকা বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানেই থাকে। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী বৈশ্বিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ সংস্থা এক প্রতিবেদনে বলেন, ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষিত শহর, শীত মৌসুমে আসলে বায়ুদূষণের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। যান্ত্রিক যানবাহন, ইটভাটা ও কলকারখানার ধোঁয়া বায়ুকে দূষিত করে চলেছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরে কেন এত বেশি দূষণ বাড়ছে, তা উঠে এসেছে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, সড়ক ঝাড়ু দিয়ে জমা করা ময়লার একটা অংশ গভীর রাতে ফুটপাতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ওই ময়লার বড় অংশ থাকে প্লাস্টিক বর্জ্য, যা পোড়ানোর কারণে বিষাক্ত উপাদান বাতাসে যুক্ত হয়। তাতেই বাতাসে বাড়তি দূষিত পদার্থ যোগ হয়। এজন্য দায়ী আশরাফুল মাকলুকাত নামক মানুষ। কিন্তু আমরা ইচ্ছা করলে এই বায়ুদূষণ একেবারে বন্ধ না করতে পারলেও তা ৫০ হতে ৭০ ভাগ কমিয়ে আনতে পারি।

সুপেয় পানি ও বিশুদ্ধ বায়ু মানুষের জীবন বাঁচায় অথচ এগুলো মূল্যহীন। কিন্তু মানুষের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হীরার ভূমিকা একেবারেই গুরুত্বহীন হওয়ার পরও হীরার উচ্চমূল্যের বস্তু! অ্যারিস্টটলের কাছে এই বিষটি বিস্ময় ছিল, যদিও এর কোনো কারণ তিনি খুঁজে পাননি, তবে তিনি এই অন্যায্য পদ্ধতিকে বলেন প্রহেলিকা। মণি-মাণিক্য মহামূল্যবান বস্তু, কেননা তা দুষ্প্রাপ্য। এই হিসাবে বায়ুর মূল্য অনেকের কাছে বেশি নয়। কারণ তাকে কোনো অর্থ মূল্য ছাড়াই পাওয়া যায়। কিন্তু করোনা মহামারির সময়ে বোঝা যাচ্ছে বিশুদ্ধ বায়ুর মূল্য কতখানি। বায়ু ও পানি জিনিসটা নিত্যপ্রয়োজনীয় অথচ এর দাম নাই অনেকের কাছে। কিন্তু যদি কখনো এটির একান্ত অভাব হয়, রাজা-বাদশাহরা বোধ করি একফোঁটার জন্য মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলে দিতেও ইতস্তত করেন না। পানি বাণিজ্যিকীকরণের ফলে বলিভিয়া যে রকম গৃহযুদ্ধ লেগে ছিল। বাংলাদেশে বিশুদ্ধ বায়ুর অভাব দেখা দিয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে যদি কোনো দিন ভারতের দিল্লির মতো অক্সিজেন বারে গিয়ে বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করতে হয়, সেই দিন বিশুদ্ধ বায়ুর যথার্থ মূল্য কত, সেই তর্কের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে, আজ নয়।

বর্তমান সময়ে পানি ও বায়ু সুলভ হলেও কিন্তু দাম যাচাই করারও একটা পথ পাওয়া গেল। কিন্তু পানি ও বায়ুর সাধারণ মূল্য ধার্য করবে কী করে? যখন এর জন্য জীবন শেষ হয়ে যায়। আমরা পানি ও বায়ুর মূল্য দিতে জানলে এগুলোকে দূষণ করতাম না। আগে মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনের কথা জানা গেলেও, এখন প্রায়ই জানা যায় এটা বিশুদ্ধ পানি ও বায়ুর জন্য হাহাকার দেখে।

বায়ুদূষণ রোধে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বিভিন্ন এলাকায় প্রায় সাত লাখ লিটার পানি ছিটানো হয়েছে (গত ২৯ মার্চ ২০২১)। পানির গাড়িতে করে ৪৭টি ট্রিপে প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার সড়ক এবং ৯৬ লাখ বর্গফুট এলাকায় এই পানি ছিটানো হয়, যা মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানের রূপের চিকিৎসার মতো বলা চলে। মুমূর্ষু সন্তানের রূপের চিকিৎসা বাদ দিয়ে জীবন বাঁচতে চেষ্টা করুন। যে কাজ করতে অর্থের প্রয়োজন নেই, রাষ্ট্রের সেই কাজ করতে সুদৃষ্টি দিন। যে কাজ করতে অর্থের অপচয় হচ্ছে তা আপাতত স্থগিত রাখুন, যেহেতু রাস্তায় পানি ছিটাইতে অর্থের দরকার। বায়ুদূষণ বন্ধ করতে একটি গেজেট নোটিফিকেশন যথেষ্ট। যেহেতু বায়ুদূষণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির জন্য দায় নিচ্ছে না। তাই এখনই বায়ুদূষণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হুলিয়ার আদেশ জারি করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।

কোনো একটি পানির পাত্র ছিদ্র হলে গেল, আর কিছু মানুষ পানির পাত্রটির ছিদ্র বন্ধ না করে পাত্রে শুধু পানি ঢেলে যাচ্ছেন। আমার দেশের কিছু কর্তৃপক্ষের কাজ আমার কাছে এ রকম মনে হচ্ছে। বায়ুদূষণে প্রধান কারণ যান্ত্রিক যানবাহনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, ইটের ভাটা, কলকারখানার ধোঁয়া এবং প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানো ধোঁয়া। অর্বাচীন কর্তৃপক্ষ এগুলোর ব্যবহার বন্ধ না করে, পানি ছিটিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারবেন বলে হয় না, এটা কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে এই দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৫ সালে দেশটির বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের অপমৃত্যু হয়েছে এই তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (ইপিএ)। বর্তমানে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৪০ হাজার নিরপরাধ মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে, এর দায় কর্তৃপক্ষ নেবেন কি? কারাদণ্ড ও জরিমানা বা উভয় শাস্তির এমন বিধান রেখে ‘নির্মল বায়ু আইন, ২০১৯’ খসড়া প্রস্তুত করলেও এখন পর্যন্ত উক্ত আইন মহান জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস করছে না। যদিও বায়ুদূষণের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশ এবং সম্পদও নষ্ট হচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশের মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ১২ মার্চ ২০১৯ ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। তার পরও যথাযথ কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।

রাষ্ট্রের যা জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন; যান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে সারা দেশে রেলকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থা তৈরি করা। শহর ও নগরে অযান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার বাড়ানো, এজন্য শহরে ট্রাম ও গণপরিবহনকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরকে বিকেন্দ্রীকরণ করে সব নাগরিক সুবিধা জেলা ও উপজেলায় নিশ্চিত করা। এতে করে অযাচিত যাতায়াত হ্রাস পাবে। ফলে যান্ত্রিক যানবাহনের ওপর নির্ভরতা কমবে। ইটভাটা বন্ধ করে বিকল্প ইটের দিকে যাওয়া। যেমন : ব্লক ইটের মাধ্যমে অবকাঠামো তৈরি নিশ্চিত করা। পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরি করা। একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা। তাই জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় বাস্তবিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আন্তরিক সুদৃষ্টি কামনা করছি।

লেখক : আইনজীবী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close