ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

  ০২ ডিসেম্বর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে নেই বাংলাদেশ

মিসরে অনুষ্ঠানরত কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিবিষয়ক প্রধান আচিম স্টেইনার বিশ্বের ধনী দেশগুলো জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা না করলে ৫০টির অধিক উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশ ঋণখেলাপি এবং কার্যত দেউলিয়া হওয়ার প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন। দেউলিয়া হওয়ার শঙ্কায় থাকা দেশের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতি-জ্বালানি সংকট এবং ক্রমবর্ধমান সুদের হারের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের তালিকায় ৫৪টি দেশ রয়েছে। যদি আমরা আরো ধাক্কা খাই, সুদের হার বেড়ে যায়, ঋণ গ্রহণ আরো ব্যয়বহুল হয়ে যায়, জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্য বাড়ে, তাহলে আমরা দেখব যে, বিশালসংখ্যক দেশ ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এতে একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হবে, যেমনটা হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে ঋণখেলাপির ঝুঁকি বাড়ে।’ তার মতানুসারে, এ ধরনের ত্রুটি জলবায়ু সংকট সমাধানে আরো সমস্যা তৈরি করবে। ঋণ পরিশোধে দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য করা আবশ্যক। এ সমস্যা এখন অনেক উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ুবিষয়ক কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করার জন্য এ সংকট সমাধান পূর্বশর্তরূপে প্রতিভাত।

গত ১২ নভেম্বর বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এ সম্মেলনে অংশ নিয়ে জানান, উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থ সংকট ও ঋণের বোঝায় জর্জরিত। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছে দেশগুলো। তিনি বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলো আজ নিজেরাই একটি সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। বর্তমানে নানা কারণে উন্নয়নে বিপর্যয় হচ্ছে, যা অনভিপ্রেত। সংকুচিত অর্থনীতি, চরম দারিদ্র্য, শিক্ষা-বিদ্যুৎ-বিশুদ্ধ পানি-অবকাঠামোর অভাব এবং উচ্চ বেকারত্ব ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো পুনরুদ্ধারে অর্থায়নে নিযুক্ত রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিটি পরিবর্তন আরো খারাপ হয়েছে, যা পুনরুদ্ধারে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক।’ চলতি বছরের অক্টোবরে ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, ‘চলমান বৈশি^ক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব উন্নয়নশীল বিশ্বেও পড়বে। এসব দেশের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য উন্নত বিশ্ব হওয়ায় দেশগুলোর অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রভাবে বিশ্বের সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

এ বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে যে, বিশ্বমন্দার ঝুঁকিগুলো আরো বাড়ছে। বিশ্বের এখন এক-তৃতীয়াংশ দেশ এ বছর না হলেও আগামী বছর মন্দায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে। পরপর দুটি ত্রৈমাসিক হিসাবে তাদের প্রবৃদ্ধি না হয়ে বরং অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে যাবে। গত বছর আইএমএফ ধারণা করেছিল, বিশ্ব অর্থনীতিতে এ বছর ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসবে, যা আগামী বছর আরো কমে ২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে যেতে পারে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে শুরু করলেও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নতুন নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। শুধু নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নয়, এখন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে অর্থ উন্নত দেশে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘এখন দেশগুলোর প্রধান লক্ষ্য হতে হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু মুদ্রানীতি অতটা কঠোর করা যাবে না। অনেক বড় দেশ খুব দ্রুত নীতি সুদ হার বাড়িয়ে যাচ্ছে। ঋণের খরচ বেড়ে গেলে সেটি উৎপাদন কমিয়ে দেবে। আর উৎপাদন কমে গেলে বেকারত্ব বেড়ে যাবে। এতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হবে। এজন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ ধাপে ধাপে নেওয়া দরকার। মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য সহায়তা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। আগামী তিন প্রান্তিকে অর্থাৎ ৯ মাসের মধ্যে উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে উন্নত বিশ্বে অর্থের প্রবাহ বাড়বে ৪০ শতাংশ। তাছাড়া নিম্ন-আয়ের দেশগুলোয় ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। নিম্ন-আয়ের দেশগুলো অন্তত ৬০ শতাংশ ঋণ সংকটে পড়তে পারে। এসব দেশের ঋণ সংকট কাটাতে সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।’

দেশের অর্থনীতিবিদদের মতে, ডলারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর আমদানি খরচ বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং উদ্ভূত সমস্যা বিশ্ব অর্থনীতিকেও এক ধরনের ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত করেছে। ডলারের উচ্চমূল্য বিশ্ব অর্থনীতির গুটিকয়েক দেশে কিছুটা সামঞ্জস্য আনতে পারলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলো অতিমাত্রায় বিপর্যস্ত। বর্তমান পরিস্থিতিতে ডলারের দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিতে যে দেশগুলো কিছুটা উন্নতি করেছিল, তাদের এবং বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর বর্তমান অস্থিতিশীল আর্থিক বাজারকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে; বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে এর প্রভাব খুবই তীব্র হবে। এ ছাড়া যেসব দেশ জ্বালানিসহ খাদ্য ও ঋণের সমস্যা নিয়ে সংকট মোকাবিলা করছে, তাদের জন্য পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে। তারা আরো বলেন, ‘এ ধরনের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান স্থবিরতা বাহ্যিক প্রবৃদ্ধির নিয়ামকগুলোকে দুর্বল করার পাশাপাশি চলমান আর্থিক বাজারে চরম অস্থিরতা তৈরি করবে। বিশেষ করে একাধিক ঝুঁকি নিয়ে বহুমাত্রিক আর্থিক স্থবিরতা মোকাবিলাকারী উন্নয়নশীল দেশগুলো।

২০২১ সালে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এ তিনটি সূচকে শর্ত অনুযায়ী উন্নতি করায় বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের পদার্পণের সুপারিশ করে। ফলে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গেলে বাংলাদেশকে কিছু সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে; তা হলো, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ না পাওয়া। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের ঘাটতিতে এখনো বিদেশি ঋণের প্রয়োজনীয়তা থাকায় এজন্য বিকল্প ঋণের উৎস খুঁজতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপের বাজারে এভরিথিং বাট আর্মস (ইভা) কর্মসূচির আওতায় রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর এ সুবিধা চলে যাবে। তাই বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণসহ প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

গত ৩ আগস্ট গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, করোনা মহামারি-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারসহ বিভিন্ন সংকট কাটিয়ে অর্থনীতির ইতিবাচক ধারায় দেশ পরিচালিত করছে বলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছেন। থাইল্যান্ডের ব্যাংকক পোস্টের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে ভারতের কর্ণাটকভিত্তিক গবেষক ও বিশ্লেষক জন রোজারিও বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার মতো সংকট হবে না বাংলাদেশের। ব্লুমবার্গের তথ্যের ভিত্তিতে ভিজুয়াল ক্যাপিটালিস্ট প্রকাশিত সম্প্রতি ঋণঝুঁকিতে থাকা ২৫টি দেশের তালিকায় রাশিয়া, জাম্বিয়া, সুরিনাম, লেবাননসহ কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে ঋণ পরিশোধে পিছিয়ে আছে। অপর দেশগুলোর মধ্যে আর্জেন্টিনা, ইউক্রেন, তিউনিসিয়া, ঘানা, মিসর, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, এল সালভাদর, পাকিস্তান, বেলারুশ ও ইকুয়েডর রয়েছে মূল্যস্ফীতি-ঋণ-উচ্চঋণের ব্যয়ের তালিকায়। দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বেলারুশ। এ তালিকায় নেই বাংলাদেশ। কারণ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও গতিশীল নেতৃত্বে অর্থনীতিকে সমান গতিতে রাখার প্রায়োগিক পদক্ষেপ সর্বত্রই সমাদৃত। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সীমিত করা, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমানো, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সে নগদ প্রণোদনা দেওয়া, বিলাসবহুল পণ্যে করারোপ করার মতো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে আমদানির চাহিদা সহজে মেটানো যায়। এরই মধ্যে সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে রপ্তানি বৃদ্ধি এবং আমদানি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত ডিপ্লোমেটিক এডিটর দীপরঞ্জন রায় চৌধুরীর লেখা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মন্দায়ও বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক মন্দায় ভুগছে সারা বিশ্ব, যার প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয়। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উদ্বেগজনকভাবে কমেছে পাকিস্তানেও। এমন আঞ্চলিক ভূ-অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও নিজেদের অর্থনীতি স্থিতিশীল রেখেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর সময়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সফল ও সার্থক হয়েছে এ রাষ্ট্র। বিস্তৃত উৎপাদন খাত এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন; সব মিলে বাংলাদেশের অর্থনীতি এশিয়ার মধ্যে অনুসরণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র মতো নিন্দনীয় উক্তির বিষয় তুলে ধরে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তার প্রমাণ হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া পদ্মা সেতু। যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা এ সেতুর অর্থায়নে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল; তারাই এখন বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। এ সেতুর কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক শক্ত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ নিজেই উন্নয়নের একটি রোডম্যাপ দিয়েছে। ভিশন-২০৪১ নামের এ রোডম্যাপের লক্ষ্য ২০৩১ সালের মধ্যে প্রকট দারিদ্র্যের অবসান এবং উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রেও অগ্রগতি অর্জন করছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে পাকিস্তানের দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে পাকিস্তানিদের উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিখুন। তিনি বাংলাদেশের গর্ব।

লেখক : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close