রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৮ নভেম্বর, ২০২২

আন্তর্জাতিক

ব্রিটিশ অর্থনীতি এখন জোড়া ধাক্কার মুখে

করোনা মহামারির প্রকোপ শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোল আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতাকে দীর্ঘায়িত করছে। কারণ, বিশ্বের অন্যতম খাদ্য জোগানদাতা রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় সরবরাহ ব্যবস্থায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটেছে। বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম তো বেড়েছেই। বদৌলতে দুনিয়াজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। আবার মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরির হার না বেড়ে বরং কমে যাওয়ায় অনেক দেশেই জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের চাপ তো আছেই। এর ওপর মার্কিন ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রার বিনিময় হারে ধস নামার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বহু দেশ। বৈদেশিক ঋণ লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কার মতো বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিতেই এখন টালমাটাল অবস্থা শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে গিয়ে সরকারগুলো কিছু ভুল করবে, যা তাদের অর্থনীতিতে স্বস্তির পরিবর্তে বিপদ ডেকে আনতে পারে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আরো একটি মন্দা ধেয়ে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে। জাপানের আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নোমুরা বলেছে, আগামী এক বছরের মধ্যে বিশ্বের বড় বড় অনেক অর্থনীতি মন্দায় পড়বে। এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা কঠোর করতে গিয়ে কিছু ভুল করে বসবে, যা কিনা সংকট-মন্দা ত্বরান্বিত করতে পারে। সংকট-মন্দার ঝুঁকিতে থাকা উল্লেখযোগ্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা। যুক্তরাজ্য ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত। এটি ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের সমন্বয়ে গঠিত।

ব্রিটেনের মানুষের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে জ্বালানির মূল্য। বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস, আসছে শীতে দেশটির মানুষের পরিবারপ্রতি জ্বালানি ব্যয় ৩ হাজার ৬০০ ডলারে উঠতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সে দেশের অনেক মানুষ জ্বালানি দারিদ্র্যের কবলে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন সম্প্রতি এক কলামে জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানি বাজেট ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, পরিস্থিতি নির্মম, অনস্বীকার্য বিষয়টি হলো ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয়বার জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করার কারণে দেশের সব পরিবার ধাক্কা খেয়েছে আর তাতে লাখ লাখ মানুষ খাদে পড়ে গেছে। যুক্তরাজ্য ১৯৯৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখেছিল এবং এটি সম্ভবত ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি বা মার্গ্রেট থ্যাচারের সংস্কারের ফলাফল বলেই মনে হয়েছিল। ২০০৮ সালে আর্থিক সংকটের ফলে স্পষ্টভাবে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছিল। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার আগেই ব্রিটেনের উৎপাদনশীলতা কমে গিয়েছিল। আর এই ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দাকেই রাজনীতিবিদরা কাজে লাগান ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অজুহাত হিসেবে। দেশটি ২০১৬ সালে গণভোটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ব্রিটেনের উৎপাদন হয়তো বিশিষ্টভাবে প্রদর্শিত হয় না, তবে তারা প্রচুর অর্থ আয় করে। ব্রিটেনের জিডিপির চার ভাগের তিন ভাগই আসে আর্থিক পরিষেবা এবং বিমা থেকে। একে আপনি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিও বলতে পারেন। নিউইয়র্ক সিটির পরে লন্ডন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। দিন যত যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা তত বাড়ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আগস্টে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ব্রিটিশ পাউন্ডের দর কমেছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, যা মাসিকভিত্তিতে ২০১৬ সালের পর সর্বোচ্চ।

এদিকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্বাভাসে জানিয়েছে, চলতি বছরের শেষের দিকে মন্দায় প্রবেশ করবে যুক্তরাজ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের আগস্টে শুধু ডলারের ক্ষেত্রেই নয়, ইউরোর বিপরীতেও খারাপ অবস্থানে ছিল ব্রিটিশ পাউন্ড। ইনভেস্টেকের সিনিয়র ইনভেস্টমেন্ট ডিরেক্টর লরা ল্যাম্বি বিবিসিকে বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাকি বিশ্বের তুলনায় বিশেষ ভালো দেখাচ্ছে না। তিনি বলেন, বাজারে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। তা ছাড়া বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ড ম্যান শ্যাস সতর্ক করে জানিয়েছে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত মন্দার মধ্যে থাকতে পারে যুক্তরাজ্য। অন্য দিকে করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কয়েক দশকের মধ্যে তীব্র খরা-দাবদাহের কারণে ইউরোপজুড়ে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। এতে এক দিকে যেমন মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে অন্যদিকে কমছে প্রবৃদ্ধি। এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বেকায়দায় পড়ছে সরকারগুলো। ধারণা করা হচ্ছে, চলমান পরিস্থিতির মধ্যেই অঞ্চলটিতে অর্থনৈতিক মন্দা আসন্ন। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে তা নির্ভর করছে জ্বালানি সংকট ও নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তের ওপর। চলতি সপ্তাহে অঞ্চলটিতে জ্বালানির দাম অকল্পনীয়ভাবে বেড়েছে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই অঞ্চলটিতে লাফিয়ে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার। আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। এর আগে রয়টার্সের জরিপে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। গত ৯ মাস ধরেই অঞ্চলটিতে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী, যা শুরু হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে। জুলাইতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৯ শতাংশে। ইউরোপীয় অর্থনীতি যুক্তিসংগতভাবে শক্তিশালী অবস্থানে থাকার মধ্যেই সংকটে প্রবেশ করেছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যুদ্ধ শুরু হওয়া পর ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাস কমলেও ব্যয় কমেনি।

ব্রিটেনে ৪১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। প্রভাব পড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে। জীবনযাত্রায় ব্যয় নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছেন বাসিন্দারা। এতে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে দেখা দিয়েছে নাভিশ্বাস। এদিকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাগামহীন দাম বৃদ্ধির কারণে পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেইনসহ বিভিন্ন এলাকার বাংলাদেশি অনেক রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি ব্রিটেনের স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকেই তাদের নিত্যদিনের ব্যয় তালিকা সংকুচিত করছেন। জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয় থেকে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, অক্টোবর পর্যন্ত গত ১২ মাসে যুক্তরাজ্যে ভোক্তা পণ্যের দাম ১১ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে গেছে। যা ১৯৮১ সালের অক্টোবরের পর সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে ১০ দশমিক ১ শতাংশ। ওএনএস জানায়, যুক্তরাজ্যে এখন একটি পরিবারকে বাড়িতে জ্বালানি বিল হিসেবে গড়ে বছরে আড়াই হাজার পাউন্ড ব্যয় করতে হচ্ছে। পরিসংখ্যান কার্যালয়ের তথ্য প্রকাশের পর এক বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলেন, দেশের আর্থিক অবস্থা নিয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে দেশের মুদ্রস্ফীতি তাদের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করা আমাদের সবার কর্তব্য। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ফুড ফাউন্ডেশন ব্রিটেনের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, প্রতিদিন যুক্তরাজ্যের লক্ষাধিক মানুষ তিন বেলা খেতে পারছেন না। বছরের প্রথম তিন মাসে প্রতি সাতজনের একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনো বেলা খাবার পাননি বা তাদের খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না। আর এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে। বড় চেইনশপগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম অন্যান্য দোকানপাটের চেয়ে তুলনামূলক কম থাকে। কিন্তু এসব সুপারশপেও এখন দাম বেড়ে চলছে। বছরের ব্যবধানে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে শীতের সময় গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ইংল্যান্ডের জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা অফজেম দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে। এতে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড আগেই শঙ্কা জানায় যে, মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এখন এই যুদ্ধের ধাক্কায় মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে ওঠে যেতে পারে- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত হার ২ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি থাকবে দীর্ঘদিন। শুধু যুক্তরাজ্য নয়, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও তেলের দাম এভাবে আরো কিছুদিন বেশি থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হারও এ বছরের শেষভাগে ৬ শতাংশে উঠতে পারে। রাশিয়ান রুবল ও ব্রাজিলের রিয়েল ছাড়া বিশ্বের আর প্রায় সব মুদ্রার বিপরীতেই এ বছর মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে। এখন বহু দেশের স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বিগত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। ডলারের ক্রমবর্ধমান মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন দেশকে আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থাৎ আমদানি ব্যয় পরিশোধে বেশি পরিমাণে অর্থ ঢালতে হচ্ছে। কারণ, বেশির ভাগ মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে নেমে গেছে। এতে দেশগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ছে। ফলে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠছে।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close