ড. জগৎ চাঁদ মালাকার

  ২৭ নভেম্বর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

এক ইঞ্চি জমিও ফাঁকা রাখা যাবে না

আমাদের দেশের মাটি বিভিন্ন মসলা যেমন- আদা, হলুদ, সবজি ও ফল চাষের জন্য উপযোগী। কিন্তু বিষয় হচ্ছে অনেকে বসতবাড়িতে চাষোপযোগী স্থান থাকা সত্ত্বেও অনাবাদী রেখে দেয়। এতে নিজেদের চাহিদাও যেমন মিটছে না, তেমনি মানুষের প্রয়োজনেও তা আসছে না। এর ফলে রাষ্ট্রকে প্রতি বছর বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ মসলা ও ফল আমদানি করতে হয়। এতে ব্যয় হয় অনেক বৈদেশিক মুদ্রা। অথচ মানুষ একটু সচেতন হলে এই ব্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে এবং নিজেদের উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মেটাতে পারে। এই অবস্থায় অনেকে আক্ষেপ করে বলে থাকেন ‘দয়াল বাবা কলা খাবা গাছ লাগাইয়া খাও’। কিন্তু সেখানেই যেন আমাদের যত আপত্তি। দিনের পর দিন জমি বলেন আর বসতবাড়ি তা খালি পড়ে থাকলেও চাষাবাদে কোনো মনোযোগ নেই। তাইতো কবি বলেন, ‘এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা/মনরে কৃষি কাজ জাননা’।

অন্যদিকে, নিরাপদ খাদ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন দেশ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ, দূষণকারী বস্তু, অণুজীব, রোগ ও পোকামাকড় ইত্যাদির পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করছে। বিপরীতে আমাদের দেশের বেশির ভাগ বাড়িতে অপরিকল্পিতভাবে নানা গাছগাছড়া দিয়ে ভরে রাখা হয়েছে। এতে আলো-বাতাস ঢুকে না। আবার কোথাও কোথাও ফাঁকা, পতিত জমি পড়ে আছে যেগুলো আবাদের আওতায় আনা যাচ্ছে না। কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই বসতবাড়ির বিভিন্ন ফাঁকা স্থানে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সহজেই মসলাসহ ফলফলাদির উৎপাদন সম্ভব।

বসতবাড়িতে সবজি চাষ আমাদের গ্রামগুলোতে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে মানুষের শহরমুখিতা ও জীবনযাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় অনেকেই বসতবাড়িতে আগের মতো সবজি আবাদ করছে না। ব্যাপক চাহিদার কারণে বাজারে এখন সবজির উচ্চমূল্য। যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে বেশির ভাগ মানুষ সবজি কিনে খেতে পারে না। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য তথা মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

আমাদের দেশের আবহাওয়া ও মাটি ফল চাষের উপযোগী। এ দেশে প্রায় ১৩০ প্রজাতির ফল উৎপাদিত হয়ে থাকে তার মধ্যে প্রায় ৯টি প্রধান। দেশের মোট আবাদী জমির প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ ফল আবাদের আওতাধীন। দেশের মোট ফল উৎপাদনের প্রায় ৫২ শতাংশ উৎপাদিত হয় বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসে। বাকি ৪৮ শতাংশ আবাদ হয় বছরের অবশিষ্ট ৮ মাসে। শীত মৌসুমে দেশে ফলের আবাদ সবচেয়ে কম। অথচ বসতবাড়িতে পরিকল্পিতভাবে নিরাপদ ফল আবাদ করে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি।

স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য দৈনিক আমাদের বিভিন্ন ধরনের খাবার দরকার। সে বিষয়ে অনেকেরই তেমন ধারণা নেই। অনেকেই খাবার বলতে ভাত, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদিকে বুঝে থাকলেও কোনটি শরীরের কী কাজ করে সে সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। এতে দেহের প্রয়োজনানুসারে খাবার সরবারহ নিশ্চিত হয় না এবং আমরা অপুষ্টিতে ভুগতে থাকি। এই অপুষ্টির জন্য আমাদের দরিদ্রতার চেয়ে বেশি দায়ী খাবার সম্পর্কিত অজ্ঞতা।

মানুষের সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা- এই পাঁচটি উপাদান একান্তই দরকার। সামগ্রিকভাবে একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে সে দেশের মোট খাদ্যের প্রাপ্যতা, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা এবং খাবার গ্রহণের ওপর (সুষম বণ্টন)। বর্তমান উৎপাদন পরিস্থিতিতে ধান বাদে অন্যান্য ফসল যেমন- গম, আলু, তেলবীজ, ডাল ও শাকসবজি উৎপাদন দেশের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি উৎপাদনেও যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া প্রাপ্যতা থাকলেও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকায় অনেকেই কিনতে পারছে না। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার ৫৩ শতাংশ আমরা পাই দানাদার খাদ্যশস্য থেকে যা দৈনিক ২ হাজার ১২২ কিলো-ক্যালোরির ৭৫ শতাংশ। বাকি ২৫ ভাগ কিলো-ক্যালোরি আসে ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও তেল থেকে। আমাদের প্রতিদিন ৮৫ গ্রাম ফল এবং আলুসহ অন্যান্য শাকসবজি খাওয়া উচিত ২৫০ গ্রামের বেশি। আমরা খেয়ে থাকি পাতা জাতীয় ২৩ গ্রাম, পাতা জাতীয় ছাড়া ৮৯ গ্রাম এবং আলুসহ শাকসবজি ১১০ গ্রামের মতো যার মধ্যে প্রায় ৭০ গ্রাম আলু ও ফল ১৪ গ্রাম। আমাদের খাদ্য তালিকায় ফল ও শাকসবজি খুবই কম থাকে।

আমাদের মাটি ও পরিবেশ ফল ও শাকসবজি উৎপাদনে সহায়ক। বসতবাড়ির আঙিনায় হতে পারে সুন্দর সবজি বাগান। সেখানে চাষ করা যায় লালশাক, ঢ্যাঁড়শ, ডাঁটাশাক ইত্যাদি। ঘরের চালে, বেড়ায়, মাচায় করা যায় লাউ, শিম, বরবটি, কাঁকরোল, করলার ইত্যাদি চাষ। প্রতিটি বাড়িতে ২-৩টি পেঁপে গাছ, লেবু, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, আমলকী ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে। ফল ও সবজি চাষ করলে নিশ্চিত হবে সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিয়ামক পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার।

বসতবাড়িতে সবজি ও ফল চাষের গুরুত্ব : ১. স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিন মাথাপিছিু ২৫০ গ্রামেরও বেশি সবজি খাওয়া প্রয়োজন। ২. বছরব্যাপী টাটকা সবজি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। ৩. শাকসবজি থেকে প্রাপ্ত পর্যাপ্ত ভিটামিন ও খনিজ লবণ পাওয়া যায়। ৪. গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি অভাব হচ্ছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, লৌহ, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন। ৫. বাংলাদেশে শতকরা ৪২ ভাগ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। অপুষ্টিজনিত কারণে রক্তশূন্যতা, মুখের ঘা, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া, বেরিবেরি, গলগ- ইত্যাদি রোগ হয়। ৬. ভিটামিন-এ এর অভাবে শিশুর রাতকানা রোগ হয় এবং শিশু অন্ধ হয়ে যেতে পারে। ৭. বাজার থেকে সংগৃহীত বেশির ভাগ সবজিতে লুকায়িত কীটনাশকের বিষক্রিয়া মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৮. বাড়ির আশপাশে পড়ে থাকা পতিত-অব্যবহৃত জমিতে পরিবারের সদস্যদের অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে পারিবারিক সবজি বাগান করা যায়। যা থেকে নিজের পছন্দমতো এবং টাটকা সবজি পাওয়া সম্ভব। আমাদের দেশে বসতবাড়ি আছে ১ কোটি ১৮ লাখ। শাকসবজি ও ফলের চাষ করে বসতবাড়িকে পরিণত করতে হবে একটি সুন্দর স্বাবলম্বী বাড়িতে। কারণ ওই বাড়ি হতে পারে আমাদের সুষম খাদ্য ভা-ার। পারিবারিক আয় বিশেষ করে মহিলাদের আয়ের সুযোগ তৈরি হয়। ৯. অবসর সময়ে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়। নিজের উৎপাদিত সবজি খেয়ে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। প্রতিবেশীকে সবজি বিতরণের মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

সবজি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা : সবজি সব সময় টাটকা খেতে হবে। সবজি কাটার পর ধোয়া যাবে না। কাটার আগে সবজি ধুয়ে নিতে হবে। সবজি কাটার পর ধুয়ে নিলে পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন-বি ও সি এবং খনিজ লবণ চলে যাবে। সবজিতে অবস্থিত ভিটামিন এ, ডি, ই, কে আমাদের শরীরের জন্য গ্রহণোপযোগী করতে হলে সবজিকে তেল দিয়ে রান্না করে খেতে হবে। রঙিন সবজিতে ওই ভিটামিনগুলো প্রচুর পরিমাণে থাকে।

ভিটামিনগুলোর অভাবে যা হয় : ১. ভিটামিন বি-২ এর অভাবে ঠোঁটের কিনারায় ঘা হয় এবং বি-এর অভাবে শারীরিক দুর্বলতা হয় এবং মাংসপেশি চাবায়। ভিটামিন-সি এর অভাবে দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্ত পড়ে। বিভিন্ন চর্মরোগ হতে পারে এবং স্কার্ভি রোগ হয়। ২. ভিটামিন-এ এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়। দীর্ঘদিন রাতকানা থাকলে শিশু অন্ধ হয়ে যায়। ৩. ভিটামিন-ডি এর অভাবে শিশুর হাড় শক্ত হয় না, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। শিশুর রিকেট রোগ হয়। শিশুকে রোদে রাখলে এর অভাব পূরণ হয়। ৪. ভিটামিন-ই এর অভাবে মানুষের যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সন্তান ধারণ এবং জন্ম দিতে পারে না। ভিটামিন-ই ত্বক ও চুল সুন্দর করে থাকে। ৫. ভিটামিন-কে এর অভাবে শরীর কেটে গেলে সহজে রক্ত জমাট বাঁধবে না।

সব শেষে বলা যায়, রাসায়নিক কৃষি উপকরণের এলোপাতাড়ি ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে বাড়ছে দূষণের মাত্রা। জনস্বাস্থ্য হচ্ছে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পিতভাবে নিরাপদ শাকসবজি, মসলা ও ফল আবাদ করে ১২ মাসই আমরা নিজেদের ফলের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি। এই ফসল খেতে সুস্বাদু, বিষমুক্ত এবং বাজার মূল্য ভালো পাওয়া যায়।

লেখক : প্রকল্প পরিচালক, কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি

ঢাকা-১২১৫

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close