রেজাউল করিম খোকন

  ২২ নভেম্বর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

জলবায়ু অর্থায়ন দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পৃথিবীকে বাঁচাতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় জলবায়ু সম্মেলন বা কনফারেন্স অব পার্টিজ (কপ)। মিসরের পর্যটন নগরী শারমণ্ডআল-শাইখে জলবায়ু সম্মেলনের ২৭তম আসরটি ৬ থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত চলেছে। জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৭) এমন একসময় অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন জ্বালানি ও খাদ্য সংকটের সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দায় পৃথিবীব্যাপী অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেকটা জটিল হলেও জলবায়ু অর্থায়ন সম্মেলনের আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা, উত্তরাঞ্চল খরা, উত্তর-পূর্বাঞ্চল পাহাড়ি ঢল, মধ্যাঞ্চল বন্যা এবং পূর্বাঞ্চল পাহাড় ধসের এক নিদারুণ যন্ত্রণার মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিদিন। কেবল গ্রামীণ উৎপাদন ও খাদ্য ব্যবস্থা নয়; ভেঙে পড়ছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বহুমুখী সম্পর্ক। আবহাওয়ার উল্টাপাল্টা আচরণ কৃষিসহ প্রকৃতিনির্ভর প্রতিটি পেশায় দুঃসহ সংকট তৈরি করছে। মানুষ গ্রামে থাকতে পারছে না। জন্ম ভিটা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। ছোট-বড় শহরে প্রতিদিন লম্বা হচ্ছে জলবায়ু-উদ্বাস্তু মানুষের মিছিল। পুরুষের গন্তব্য হচ্ছে ইটের ভাটা, রিকশা চালানো বা দিনমজুরিতে। নারীর গন্তব্য হচ্ছে গৃহকর্মী বা করপোরেট গার্মেন্ট কারখানায়। আর শিশুদের গন্তব্য হচ্ছে প্লাস্টিক, ব্যাটারি ভাঙা, বর্জ্য কুড়ানো কিংবা রাসায়নিক কারখানার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। বিস্ময়করভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তু এই মানুষদের কেউ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করেনি। বছরে এদের খুব কম পরিবারেই খাবারের পাতে মাংস জোটে। এক বিঘত বিলাসিতা নেই জীবনে। গ্রিন হাউস গ্যাস আর কার্বণ নির্গমণের জন্য তারা দায়ী নন। কিন্তু এই নির্গমনই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াছে, জলবায়ুর আচরণ বিগড়ে দিচ্ছে। বাঁচার জন্য লড়ছে মানুষ, আবার নিরুদ্দেশও হচ্ছে বহুজন। ‘এনভায়রনমেন্টাল জাস্টিস ফোরাম’ এ প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিদিন এক থেকে দুই হাজার মানুষ স্থানান্তর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে। জলবায়ু নিয়ে ধনী দেশ ও করপোরেট এজেন্সিগুলো আজ যে নির্দয় জুয়া খেলা মাতিয়ে রেখেছে তা বন্ধ হওয়া দরকার। একই পৃথিবীতে কেউ ঘণ্টায় ঘণ্টায় বার্গার গিলে কার্বণ নিঃসরণ বাড়াচ্ছে, আর এ কারণে লবণ পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে অন্য কারো সংসার। একই দুনিয়ায় বিক্রি হচ্ছে ‘অ্যাকোয়া ডি ক্রিস্টালো টিবেটোর’ মতো ৪০ লাখ টাকার পানির বোতল, আবার শহরের বস্তিতে এক কলস পানির জন্য লাইন দিতে হচ্ছে ৩৬৫ দিন। মানুষের দশাসই কার্বন দূষণে পৃথিবী আজ মুমূর্ষু। এখনো উত্তর-দক্ষিণ বিবাদ, কাঠামোগত বৈষম্য আর নিদারুণ দ্বন্দ্ব থামছে না। চীন, মার্কিন না রাশিয়া কে হবে অধিপতি এই দরবার প্রতি মুহূর্তে বিদীর্ণ করছে পৃথিবীর শরীর। রক্তাক্ত করছে ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক বিবর্তন। বাংলাদেশ আশা করেছিল, মিসর জলবায়ু সম্মেলন পৃথিবীব্যাপী ঘুমন্ত ও জেগে থাকা জলবায়ু-জিজ্ঞাসাগুলোকে জানা-বোঝার মতো মর্যাদার ক্ষেত্র উন্মুক্ত করবে। জলবায়ুর চলতি ২৭তম আসর দুনিয়াকে বেঁচে থাকার এক নতুন বার্তা দেবে- এই আওয়াজ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জলবায়ু-দুর্গত বাংলাদেশের গ্রাম-শহরের নিম্নবর্গের মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা যেসব অঙ্গীকার করেন, তার বাস্তবায়ন আমরা দেখি না। এটি এই আয়োজনের অন্যতম বড় সমালোচনা। যত দিন পর্যন্ত না বাস্তবায়ন হবে, তত দিন সমালোচনা থাকবেই। বিশ্বনেতারা যেসব প্রতিশ্রুতি সম্মেলনে দেন, সেসব বাস্তবায়ন না করার জন্য পরে তাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে জলবায়ু সম্মেলন অনেকটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে।

২০২১ সালের জুন মাসে, পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায়, বাংলাদেশ নতুন ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। এর আরেকটি কারণ ছিল, কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে অর্থায়নের অনিশ্চয়তা। পরবর্তী সময়ে আগস্ট মাসে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক উইং বাংলাদেশের দাখিল করা পরিমার্জিত ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়। লক্ষ্যমাত্রা হলো, নিজস্ব সক্ষমতায় ২০৩০ সাল নাগাদ, জ্বালানি, শিল্প, কৃষি, বন ও বর্জ্য খাতে, সর্বসাকুল্যে ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমণ কমানো। তবে আর্থিক, প্রযুক্তি ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে উন্নত বিশ্বের সহায়তা পেলে, বাংলাদেশ আরো ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে সক্ষম হবে। এদিকে নভেম্বর ২০২১ এ বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দেয় ২০৪১ সালের মাঝে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। বলে রাখা ভালো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা এখনো পূরণ হয়নি। যে কারণে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত ও নতুন লক্ষ্যে পৌঁছাতে, সরকার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর থেকে প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা আশা করছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের ফলে অস্থিতিশীল জীবাশ্ম জ্বালানির বাজারের প্রভাব অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও পড়েছে। ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের কারণে, সরকার জ্বালানি আমদানি কমাতে বাধ্য হয়েছে। ফলশ্রুতিতে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে এবং বিদ্যুতের সংকট জনজীবনে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি শিল্প খাতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মাত্রাতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতায়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে যা পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩০ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। পরিবেশবান্ধব জ্বালানি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের নিজস্ব কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশেষত আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে তৈরি হওয়া আর্থিক চাপ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। কাজেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারে আন্তর্জাতিক সহায়তা যেমন জলবায়ু অর্থায়নের গুরুত্ব আরো সুস্পষ্ট হচ্ছে। গড়পড়তা হিসাব করলেও ২০৪১ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ পেতে, এখন থেকেই প্রতি বছর ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তার বেশি বিনিয়োগ করে যেতে হবে। আর এনডিসি অনুযায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস প্রশমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত অনুমিত ব্যয় ১৭৬ বিলিয়ন নার্কিন ডলার। জলবাযু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যার হার, তীব্রতা এবং স্থায়িত্ব বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। এতে মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষতি হচ্ছে। প্রায় প্রতি বছর, সংঘটিত হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের ফলে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার পানিতে মাত্রাতিরিক্তভাবে লবণাক্ততা বেড়েছে। এতে সীমান্তবর্তী প্রায় দুই কোটি মানুষ সুপেয় পানির সমস্যায় রয়েছে এবং কৃষিকাজের ও ক্ষতি হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ বন্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক অগ্রগতি করেছে এবং স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজনে বিশ্বে নেতৃত্বও দিচ্ছে, তবে তা যথেষ্ট নয় কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি বছর বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। সম্প্রতি স্টকহোম এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সংঘটিত ক্ষতি মোকাবিলায় ও মেরামতে বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবারগুলো বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে। উল্লেখ্য, এ ব্যয় বাৎসরিক সরকারি ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ এবং বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর অবদানের ১২ গুণের বেশি। এ থেকে সহজেই অনুমেয়, আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু সংকটের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো একটি সমাধান সামনে নিয়ে এসেছে। তারা বলছে, যারা মূলত এই সংকট সৃষ্টি করেছে, তাদের তৈরি অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির জন্য একটি তহবিল গঠন করতে হবে, নাম ‘অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি অর্থায়ন তহবিল’। অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি ও এর অর্থায়নের বিষয়টি অবশেষে অনিবার্য হয়ে উঠছে। কেউ কেউ বলতে পারেন যে খাদ্য, জ্বালানি ও জীবনযাত্রার সংকটের মধ্যে এ ধরনের অর্থায়ন অসম্ভব।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close