ডা. মাহমুদুর রহমান

  ০৭ অক্টোবর, ২০২২

স্মরণ

শাহ ছাহেব কেবলা চুনতি

১৯০৪ সালে চুনতী গ্রামে হজরত মাওলানা শাহ হাফেজ আহমদ (রহ.) (শাহ সাহেব কেবলা চুনতি নামে পরিচিত) জন্মগ্রহণ করেছেন। তার পিতার নাম মাওলানা সৈয়দ আহমদ (রহ.) এবং মাতার নাম হাজেরা খাতুন। তার পূর্বপুরুষ হজরত শাহ আলম খন্দকার আরব দেশ থেকে স্থলপথে দিল্লি আসেন। হজরত মাওলানা শাহ হাফেজ আহমদ (রহ.) বাঁশখালীর ছনুয়া মাদরাসা, চন্দনপুরা দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসা ও কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় পড়ালেখা করেন। কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে ফাজিল ডিগ্রি অর্জন করেন। কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরেন। তারপর দাদার জমিদারি দেখার জন্য আকিয়াবে (বর্তমান মিয়ানমার) চলে যান। সেখানে তিনি মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন পর তিনি ইমামতি ছেড়ে দিয়ে পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তার অলৌকিক কিছু কারামাত আমাদের বারবার নাড়া দেয়। তিনি দ্বীনের জন্য, ইসলাম প্রসারের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি ২০/২২ বছর পাহাড়-জঙ্গল, শহর-বন্দর, ঝড়-বৃষ্টিতে আল্লাহর জিকির ও হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা করে ঘুরে বেড়াতেন। মাঝে মাঝে তিনি চুনতিতে আসতেন। তার মুখে সবসময় একটি বাক্য সার্বক্ষণিক পড়তে থাকত তা হলো, ‘হাম মাজারে মোহাম্মদ (সা.) পে মর জায়েঙ্গে, জিন্দেগি মে ইয়েহি কাম কর জায়েঙ্গে’। শাহ ছাহেব কেবলার অন্যতম সহায়ক শক্তি ছিলেন নাজেমে আলা হজরতুল আল্লামা ফজলুল্লাহ (রহ.)।

শাহ ছাহেব কেবলার কেরামতের কথা এখনো লোক মুখে শোনা যায়। আরকান সড়কের গাড়িচালকদের কাছে প্রথম তার কেরামত প্রকাশ পায়। ওই সময়ে আরকান সড়ক কাঁচা থাকায় চালকদের গাড়ি চালানো কষ্ট হতো। চালকদের সাহায্যার্থে শাহ সাহেব কেবলা উপস্থিত হতেন। শাহ সাহেব কেবলা মুসলমানদের ইমানি চেতনাকে জাগরণ ও রাসুলের (সা.) জীবনের বাস্তব শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করার মহান উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে লোহাগাড়া উপজেলার চুনতির মহান আধ্যাত্মিক সাধক আশেকে রাসুল (সা.) খ্যাত হজরত আলহাজ শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ প্রকাশ (শাহ সাহেব কেবলা) (রা.) বিশ্বের একমাত্র ১৯ দিনব্যাপী সিরাতুন্নবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করে সর্বশ্রেণির মুসলমানদের জন্য প্রেরণার ঝরনাধারা এবং নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

সীরতুন্নবী (সা.) মাহফিলে আসা লাখ লাখ ভক্তের জন্য গরু, খাসি জবেহ করে মানুষকে খাওয়ানো হয়। এতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা থাকে না। কোনো রকম ঝামেলা থাকে না। সব নীরবে এক অলৌকিকভাবে চলতে থাকে, যা আমরা এখনো দেখতে পাই।

আমার বয়স যখন তিন বছর তখন থেকে সিরত মাহফিল দেখে আসছি। সিরত মাহফিলের কথা শুনলে আমার হৃদয় থেকে তার জন্য শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়ে থাকে। সিরত মাহফিলের প্রতি আমার মন, হৃদয় সবসময় কাঁদে। সিরত মাহফিলের কথা মনে পড়লে শাহ ছাহেব কেবলার কথা মনে পড়ে যায়। অন্তরে, হৃদয়ে সবসময় ওনাকে ধারণ করে থাকি। সিরত মাহফিলের প্রতি আমার অনেক আন্তরিকতা ভালোবাসা রয়েছে। আমি যখন চুনতি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম, অলিকুল সম্রাট শাহ ছাহেব কেবলা (র.) আমাদের বিদ্যালয়ে সবসময় যেতেন। তিনি সেখানে আমাদের জন্য দুই হাত তুলে মোনাজাত করে মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া চাইতেন। শাহ ছাহেব কেবলাকে আমি অনেক কাছে থেকে দেখেছি, তার ভালোবাসা ও স্নেহের পরশ পেয়েছি, যা কোনো দিন ভোলার নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এরকম সিরত আমাদের জন্য শাহ ছাহেব কেবলা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তার রেখে যাওয়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শত শত আলেম ও আলোকিত মানুষ হয়ে এদেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছেন। শাহ সাহেব কেবলা ১৯৭২ সালের ১১ রবিউল আউয়াল ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক চুনতি সিরাতুন্নবী (স.) মাহফিল প্রবর্তন করেন। এই মাহফিল ১৯৭৩ সালে ২ দিন, ১৯৭৪ সালে ৩ দিন, ১৯৭৫ সালে ৫ দিন, ১৯৭৬ সালে ১০ দিন, ১৯৭৭ সালে ১২ দিন, ১৯৭৮ সালে ১২ দিন, ১৯৭৯ সালে ১৫ দিন, ১৯৮০ সালে ১৯ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে ১৯ দিনব্যাপী সিরাতুন্নবী (সা.) মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দেশবরেণ্য আলেমণ্ডবক্তারা ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সিরাতুন্নবী (সা.) গুরুত্বপূর্ণ তকরির পেশ করে থাকেন। ১৯৮৩ সালের ২৯ নভেম্বর মাহফিলের ১৯ দিন আগে শাহ সাহেব কেবলা ইন্তেকাল করেন। মসজিদে বায়তুল্লাহর দক্ষিণ পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত থেকে যেন প্রত্যক্ষ করছেন উনার রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠিত সব প্রতিষ্ঠান। মহান রাব্বুল আলামিন উনাকে জান্নাতের আলা মকাম নছিব করুন, চুনতি হাফেজ আহমদ (রহ.) প্রকাশ শাহ সাহেব কেবলা প্রবর্তিত ১৯ দিনব্যাপী সিরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলের সফলতা কামনা করি এবং মহান আল্লাহ উনার এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন। আমিন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

ট্রমা,অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ও সার্জন

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close