সাধন সরকার

  ০৬ অক্টোবর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

একুশ শতকের শিক্ষকতা

‘শিক্ষক’ এমন একটি শব্দ যে শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে ন্যায়নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা, অন্তহীন ত্যাগ, মূল্যবোধ, আদর্শবান, অনুপ্রেরণাদানকারী, শুদ্ধতা, সহায়তাকারী ও পরার্থপরতার প্রতিমূর্তি ভেসে ওঠে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক দুনিয়ার সেরা সম্পর্কগুলোর একটি। যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যত বেশি উন্নত সে দেশ তত বেশি উন্নত। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, একটি ব্রত। শিক্ষকতা পেশাকে যেসব দেশ সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছে সেসব দেশ দ্রুত সময়ে এগিয়ে গিয়েছে। শিক্ষক দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার কারিগর। নিজের সেরাটা দিয়ে একটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান শিক্ষকরা।

সময় বদলেছে। বদলেছে শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাণ্ডপরবর্তী বা পূর্ববর্তী সময়ের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান সময়ের শিক্ষাব্যবস্থার অনেক ফারাক। একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষকতা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্যবস্থার ওতপ্রোত সম্পর্ক বিদ্যমান। বাস্তবতা বলছে, বর্তমান সময়ে শিক্ষকের সম্মানের ভিত্তিটা কিছুটা হলেও নড়ে গেছে। বাংলাদেশের শিক্ষকতার চারটি স্তর বা সমমানের স্তর রয়েছে। তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা সমপর্যায়ের শিক্ষক। শিক্ষার স্তর অনুযায়ী এসব শিক্ষকের মর্যাদা, বেতন-ভাতাও ভিন্ন। শিক্ষকতার আবার দুটি ক্যাটাগরি। সরকারি ও বেসরকারি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা পান। অথচ শিক্ষার্থীর হাতেখড়ির মাধ্যমে শিক্ষার ভিত্তিটা তারাই রচনা করেন। রাষ্ট্র তাদের কাছ থেকে দেশসেরা সেবাটা চান অথচ বেতনটা দিতে চান নিম্নমানের! এ কারণে প্রাইমারিতে মেধাবীরা শিক্ষক হয়ে যেতে চান না।

শিক্ষকতা পেশা অন্যসব পেশা থেকে ভিন্ন। পৃথিবীর যেসব দেশ শিক্ষকতা পেশাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দিয়েছে সেসব দেশ আজ উন্নতপর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি একটা দেশকে দ্রুত এগিয়ে নিতে যায়। অথচ আমাদের দেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। দেশের বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ঘটনা অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষককে শিক্ষার্থী কর্তৃক অপমানিত হতে হচ্ছে। শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে। শিক্ষককে হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে। ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শিক্ষককে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। এর বিপরীত ঘটনাও সমাজে ঘটছে। অনেক শিক্ষক যৌন হয়রানির সঙ্গে জড়িত। পাশাপশি অনিয়মণ্ডঅব্যবস্থাপনার সঙ্গে অনেক শিক্ষকের জড়িত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। অনেক শিক্ষক অনিয়ম করে প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এসব ঘটনা দেশের আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বেমানান।

বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী শিক্ষার্থীকে অনেক শিক্ষক পর্যন্ত ভয় পান। এ দেশের বহু ক্ষমতাধর ছাত্রনেতা বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষকদের পাত্তা দেন না। অনেক সময় ছাত্রনেতার আবদার পূরণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পর্যন্ত বাধ্য হন! বিভিন্ন কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণা কমে যাচ্ছে। শিক্ষার মান পড়ে যাচ্ছে। দেশের মেধা শিক্ষকতা পেশায় না এসে বিদেশে চলে যাচ্ছে! বিশ্বের সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের কোনো কোনো নেতিবাচক ঘটনা শিক্ষকতা পেশার সম্মান নষ্ট করছে। শিক্ষকতাকে আদর্শ মেনে যারা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান শুধু তাদেরই শিক্ষকতা পেশায় আসা উচিত। অবশ্য এটাও ঠিক, রাষ্ট্র যদি শিক্ষকদের যথাযোগ্য সম্মান ও বেতন-ভাতা না দেয় তাহলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন না। ফলে যেনতেনভাবে শিক্ষক নিয়োগ করলে যা হওয়ার তাই হবে। রাষ্ট্র যেমন শিক্ষকদের যথাযোগ্য সম্মান করছে না, আবার শিক্ষকরা বিভিন্ন নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়ে মর্যাদা ধরে রাখতে পারছেন না।

প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে অনেক শিক্ষকের জড়িত হওয়ার খবর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। এমপিওভুক্ত অনেক শিক্ষক জাল সনদ নিয়ে ধরা খাচ্ছেন। অনেক শিক্ষক পরীক্ষার হলে ডিউটিতে পরীক্ষার্থীদের ছাড় দিচ্ছেন। এসব কারণে শিক্ষকের ওপর শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের সম্মানটা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে শিক্ষকদের ওপর হামলা, অপমান ও সম্মানহানির বিচারও সঠিকভাবে হচ্ছে না। অথচ একটা সময় ছিল শিক্ষকদের দেশের সেরা মেধাবী বলে ধরা হতো। বেতন যেনতেন ছিল কিন্তু সম্মানটা ছিল আকাশসমান। শিক্ষকের ওপর কোনো ধরনের আঘাত এলে সবাই তার প্রতিবাদ করত। এখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আঘাত নেমে এলে সম্মিলিত প্রতিবাদও দেখা যায় না। রাজধানীর ইডেন কলেজে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটে গেল তাতে কলেজের শিক্ষক, দেশের নীতিনির্ধারকের দায় এড়াতে পারেন না। ইডেনে সিটবাণিজ্য, সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি, শিক্ষার্থীদের আপত্তিকর ভিডিও ধারণসহ বিভিন্ন অনিয়মের যে অভিযোগ সামনে এসেছে তা পুরো শিক্ষার জন্য অশনিসংকেত।

একবিংশ শতাব্দীর গত দুই দশকে ছাত্ররাজনীতির নামে শত শত নেতিবাচক ঘটনা সামনে এসেছে। যে ছাত্ররাজনীতি সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষা করে না, শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে পিছিয়ে দেয় সেই ছাত্ররাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ শিক্ষার্থীসুলভ আচরণ করছে না। যার কারণে ছাত্র বহিষ্কারের ঘটনাও এখন খবরের শিরোনাম হচ্ছে। শিক্ষককে যথাযথ সম্মান দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতায় আমাদের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শেষ করে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছে না। ফলে দক্ষ কর্মীর অভাবে বিদেশিরা আমাদের দেশে এসে কাজ করে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। একটা দেশের এগিয়ে যাওয়ার মূল হলো সে দেশের আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষক নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষককে অপমান করে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারেনি, পারবেও না। নীতি ও আদর্শের শিক্ষকতার সঙ্গে কখনো আপস করা উচিত নয়। সুস্থ শিক্ষার অর্থই হলো নীতিনৈতিকতা, সততা, মূল্যবোধসম্পন্ন ও দক্ষ জাতি গঠন। দেশসেরা মেধাবীরাই শিক্ষকতা পেশায় এলে শিক্ষার্থীরা দক্ষ মানবসম্পদ হয়ে দেশের উন্নয়নে আরো বেশি অবদান রাখতে পারবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close