আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ইসলাম

ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ (সা.)

আজ থেকে প্রায় দের হাজার বছর আগে পৃথিবী এমন সভ্য, সুন্দর ছিল না। চাঁদ ছিল ম্লান, ফুল ছিল গন্ধবিহীন। থমকে ছিল নদীর তরঙ্গ, ঝরনার গান। পাখির কণ্ঠে মিষ্টি কলরব ছিল না বলে গুমরো মুখে উঠত ভোরের সূর্য। এক ভুতুরে অন্ধকার নেমে এসেছিল পৃথিবীতে। মানুষ তখন ভুলে গিয়েছিল নিজেদের পরিচয়। ভুলে গিয়েছিল তারা মানুষ। ফলে পশুত্বের চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে উঠেছিল তাদের মন। এরা এতটাই নির্দয় হয়েছিল যে, নিজ সন্তানকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলতে হাত কাঁপত না। হানাহানি, মারামারি, রক্তারক্তি, কাফেলা লুট, নারী নির্যাতনসহ এমন কোনো মন্দ কাজ নেই, যা তারা করত না।

এমনই এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে সমাজব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তনের জন্য এসেছিলেন এক মহামানব, হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি এসে সমাজে এক আশ্চর্য পরিবর্তন আনেন। তার বিভোল রাঙা পায়ের তলে তলিয়ে যায় জুলুমের রাজপ্রাসাদ। এ যেন ঠিক আধার হতে নুরের প্রদীপ জ্বলে ওঠা।

তিনি মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন আবদুল্লাহ, আর মা ছিলেন আমিনা। বাবা-মাহারা শিশু মুহাম্মদ (সা.) বড় হতে থাকেন দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং চাচা আবু তালিবের আদরে। শৈশবেই তিনি সত্যবাদিতা আর সদাচরণে সবার প্রিয় হয়ে ওঠেন। আমানতদারির বিশ্বস্ততায় উপাধি পান ‘আল-আমিন’ তথা বিশ্বাসী। সেই যুগে মানুষ যখন কারণে-অকারণে মানুষ হত্যা, লুটতরাজ, মদ্যপান, জোয়া, নারী নির্যাতনসহ নানা অপকর্মে বুঁদ হয়ে থাক, তখন যুবক মুহাম্মদ (সা.) চিন্তামগ্ন থাকতেন মানুষের মুক্তির জন্য। এক অল্লাহর ইবাদত ছেড়ে পাথুরে মূর্তি, আগুন, পানি, চন্দ্র, সূর্যের উপাসনায় মত্ত থাকা মানুষগুলোর হৃদয়ে যেমন তাওহিদের চেরাগ জ্বলে উঠুক এমন চিন্তায় বেচাইন থাকতেন, তেমনি তাদের সংস্কৃতি, অর্থনীতির পীঠ থেকে কুসংস্কারের বোঝা সরানোর ভাবনায়ও তিনি পীড়িত হতেন। অথচ তখনো তিনি নবী হননি। হেরার জ্যোতির ঝলকে পলকে ভাসেনি নুরানি পয়গাম।

আর যখন নবী হলেন, নাজিল হলো আসমানি কোরআন, তখন তো নিজ বংশের লোকগুলোই শত্রুতে পরিণত হলো। নবীজির চলার পথ হয়ে উঠল কণ্টকাকির্ণ। দয়ার সাগর নবীজি অবিশ্বাসীদের বিদ্রোপ, অমানসিক নির্যাতনে ক্ষুব্ধ না হয়ে তাদের প্রতি দয়া দেখিয়ে করুণাময় রবের কাছে তাদেরই জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ভালোবাসা দিয়ে তাদের সত্যের পথে ডেকেছেন। কারণ, তিনি যে দয়ার নবী। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এসেছে তোমাদের মধ্যকার এমন একজন রাসুল, তোমাদের দুঃখ যার কাছে দুঃসহ। তিনি তোমাদের হিতাকাক্সক্ষী। বিশ্বাসীদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১২৮)

নবীজির এই দয়া নারী-পুরুষ, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সব মানুষের জন্যই সমানভাবে ছিল। হোক সে ভিন্ন মতের বা পথের। নবীজির পাশ দিয়ে একবার এক লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি যখন তা দেখে দাঁড়ালেন, উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম তখন বললেন, এ তো ইহুদির লাশ। নবীজি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলাইসাত নাফসা?’ অর্থাৎ সে কি মানুস নয়? (বুখারি শরিফ, হাদিস : ১৩১২)

শিশুদের জন্য নবীজির দয়া ছিল অফুরন্ত বসন্ত। তিনি শিশুদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, তাদের কোলে তুলে নিতেন। আদরে আদরে ভরিয়ে দিতেন তাদের কচি হৃদয়। হজরত আবু হুরাইয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) তার নাতি হাসানকে চুমু খেলেন। সেখানে আকরা ইবনে হাবিস নামে এক সাহাবি বসা ছিলেন। হাসানকে চুমু খাওয়া দেখে তিনি বললেন, আমার ১০টি সন্তান রয়েছে। আমি তাদের কাউকে চুমু খাইনি। নবীজি তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হবে না।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৫৬৫১)

নবীজির দয়ার পরশ শুধু মানবজাতিকেই সিক্ত করেনি, করেছে বাকহীন পশু-পাখির জগৎকেও। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা এক সফরে রাসুল (সা)-এর সঙ্গে ছিলাম। একসময় একটু প্রয়োজনে দূরে গেলাম। দেখলাম একটি লাল পাখি, সঙ্গে দুটি বাচ্চা। আমরা বাচ্চা দুটি ধরে নিয়ে এলাম। কিন্তু মা পাখিটিও চলে এলো। বাচ্চা দুটির কাছে আসার জন্য পাখিটি মাটির কাছে অবিরাম উড়ছিল। তখন রাসুল (সা.) এসে পড়লেন। তিনি এটি দেখে বললেন, ‘কে এ বাচ্চা ধরে এনে এদের মাকে কষ্ট দিচ্ছে? যাও, বাচ্চা দুটি মায়ের কাছে রেখে এসো।’ (আবু দাউদ শরিফ, হাদিস : ১৪৬/২)

এজন্যই তো নবীজি লাখো কোটি হৃদয়ে সুবাসিত ফুল হয়ে আছেন, যা স্বীকার করেছেন মহাত্মা গান্ধীজিও। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জীবনগুলোর মধ্যে সেরা একজনের জীবন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম, যিনি আজ লাখো কোটি মানুষের হৃদয়ে অবিতর্কিতভাবে স্থান নিয়ে আছেন। যেকোনো সময়ের চেয়ে আমি বেশি নিশ্চিত যে, ইসলাম তরবারির মাধ্যমে সেই দিনগুলোতে মানুষের জীবনধারণ পদ্ধতিতে স্থান করে নেয়নি। ইসলামের প্রসারের কারণ হিসেবে কাজ করেছে নবীর দৃঢ় সরলতা, নিজেকে মূল্যহীন প্রতিভাত করা, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সতর্ক ভাবনা, বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য নিজেকে চরমভাবে উৎসর্গ করা।’

(Mahatma gandhi, statement published in ‘Young India’, 1924))

মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল এইচ হার্ট তার ‘দ্য হানড্রেড’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মুহাম্মাদকে আমি বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী মনীষীদের তালিকার শীর্ষে স্থান দিয়েছি, এতে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি ধর্মীয় ও ধর্মবহির্ভূত ক্ষেত্রে একযোগে বিপুলভাবে ও সর্বাধিক সফলকাম হয়েছেন।’

নবীজির পবিত্র জীবনের মূল্যায়নে এই রকম উৎকৃষ্ট উক্তি আরো অসংখ্য মনীষী করে গেছেন। তবে এসব উক্তি বা উপমা তেমন কিছুই না সেই উপমার কাছে, যে উপমা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন পবিত্র কোরআনে। আর তা হচ্ছে, সমগ্র জগতের জন্য ‘রহমত’ বলে সম্বোধন করা। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাকে বিশ্বজগতের রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া, হাদিস : ১০৭)

আরবি ‘রহমত’ শব্দের বাংলা অর্থ হলো কৃপা, পর-দুঃখমোচন, অনুগ্রহ, অনুকম্পা, বদান্যতা বা দয়া। যে দয়ার কোনা সীমারেখা নেই। যে দয়া অবারিত। সে দয়া মানুষ-অমানুষ, মুসলিমণ্ডঅমুসলিম, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, বৃক্ষলতা, পদার্থ, প্রকৃতি-পরিবেশ এবং জগৎ ও মহাজগৎ-নির্বিশেষে সবার জন্যই প্রযোজ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহেই আপনি তাদের প্রতি কোমলচিত্ত। যদি রুক্ষভাষী ও কঠোর হতেন, তবে তারা আপনাকে ছেড়ে দূরে চলে যেত।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ১৪৯)

মানবপ্রেম ছিল তার মূলশক্তি। মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা, হৃদ্যতা সৃজনের লক্ষ্যেই তার আগমন। তিনি মানুষকে বিভক্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতুবন্ধ। আজকের বকধার্মিকদের মতো তিনি অন্য ধর্মকে কটাক্ষ করতেন না। বরং বলতেন, ‘আমাদের অপরাধের জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তোমরা যা কিছু কর, সে সম্পর্কে আমরা জিজ্ঞাসিত হব না।’ অমুসলিমরা তাকে পাগল ডাকত, আঘাত করত। কঠোর ভাষায় কথা বলত। অথচ নবীজি তাদের সঙ্গে এমন কোমল আচরণ করতেন, যা শুধু নিজ পরিবারের সঙ্গেই করা হয়ে থাকে। এজন্যই তো আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যদি রুক্ষভাষী ও কঠোর হতেন, তবে তারা আপনাকে ছেড়ে দূরে চলে যেত।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ১৪৯)

দয়ার সাগর নবীজি আমার পৃথিবীর ইথারে ইথারে মহাসত্যের আলো ছড়িয়ে গেছেন। রোপণ করেছেন মানবতার বীজ। দিয়েছেন আল্লাহপ্রদত্ত সুন্দর একটি জীবনব্যবস্থা। এরপর এগারো হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখে আল্লাহতায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে মদিনা মুনাওয়ারায় শায়িত হয়েছেন। হে নবী আজও তোমায় ভুলেনি এ পৃথিবী।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close