মো. নাজমুল ইসলাম

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

সংস্কৃতি চিন্তায় দৈন্যতা

সংস্কৃতি মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্য বলা হয়ে থাকে Man is a culture building animal. মানুষ হচ্ছে সংস্কৃতি তৈরি কারক প্রাণী। সংস্কৃতি বাংলা শব্দ। নতুন বাংলা অভিধানে এর অর্থ লেখা হয়েছে সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ, কৃষ্টি, Culture। অপর এক গ্রন্থকারকের ভাষায়-সাধারণত আমরা সংস্কৃতি বলতে বুঝি মার্জিত রুচি বা অভ্যাসজাত উৎকর্ষ। সংস্কৃতিকে ইংরেজিতে বলা হয় Culture, এ শব্দটি লাতিন Colere থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো চাষাবাদ বা কৃষিকাজ। জনৈক বিশেষজ্ঞ বলেন, সংস্কৃতি শব্দটি সংস্কার থেকে গঠিত। অভিধানে তার অর্থ- কোনো জিনিসের দোষক্রটি বা ময়লা-আবর্জনা দূর করে তাকে ঠিকঠাক করে দেওয়া।

B.we টেইলর (E.B.Taylor)-এর মতে, culture is that complex whole which includes knowledge, belief, art, moral, law, custom and any other capabilities and habits acquired by a man as a member of societyÕ. অর্থাৎ সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত আচার-আচরণ, ব্যবহার, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, রীতিনীতি, প্রথা, আইন ইত্যাদির জটিল সমাবেশ হলো সংস্কৃতি।

সংস্কৃতি এমন কোনো অনতিক্রম্য, বা অবিনশ্বর বিষয় নয় যা পরিবর্তন পরিবর্ধন করা সম্ভব নয় বরং যুগান্তর ও স্থানভেদে সংস্কৃতি পরিবর্তন হয়। বঙ্গদেশে শত শত বছর আর্য, তুর্কি, আফগান-মোগল ও ইংরেজরা শাসন করেছে। তাদের শাসন প্রক্রিয়া, বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার সঙ্গে বাঙালি সমাজের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন হয়েছে। নরবলি, বর্ণপ্রথা, নগরবধূ প্রথা, গুরুপ্রসাদী প্রথা, সতীদাহ প্রথা, স্তন কর, যৌতুক প্রথা- এগুলো ছিল এ সমাজের হাজার বছরের সংস্কৃতি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেগুলো পরিবর্তন হয়েছে এবং পরিবর্তন হওয়াই কাম্য। তাহলে কোন সংস্কৃতি পালনে ‘হাজার বছর ধরে চলে আসছে’ এ কথাটি মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করা কতটুকু যৌক্তিক?

বিশ্বাসের দিক থেকে সংস্কৃতিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : ১. ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতি : যা ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ যেকোনো ধর্ম অবলম্বনকারী তার ধর্ম যে সংস্কৃতি পালনে আপত্তি করে না সে সেই সংস্কৃতি পলন করবে অন্যথা সেই সংস্কৃতি থেকে বিরত থাকবে। ২. জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি : কোনো জাতি অথবা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের খাবার, পোশাক, আচার-আচরণ, বিশ্বাস সম্পৃক্ত। ৩. তথা কথিত আধুনিক সংস্কৃতি : যা ধর্মচিন্তা এবং অবৈজ্ঞানিক আচার-ব্যবহার থেকে মুক্ত। পশ্চিমা চিন্তাবিদ ও আধুনিক বিশ্বের দৃষ্টিতে যেকোনো নতুন বিষয় ও যেকোনো নতুন চিন্তাই আধুনিক নয়; বরং একটি চিন্তা তখনই আধুনিক হবে যখন তা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। আর ওই বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি হলো ধর্মের সঙ্গে তার কোনো সংশ্রব না থাকা। Mordernity and Religion গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক বলেন : ‘আধুনিক বিশ্ব তখনই শুরু হয়েছে যখন মানুষ নিজেকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে চেষ্টা চালিয়েছে।

মুক্তমনাদের কাছে নৈতিক ও চারিত্রিক মাপকাঠি নির্ধারণে মানুষকে কেবল নিজের বস্তুগত ও পার্থিব লাভকেই বিবেচনা ধরা হয়। সেদিক দিয়ে মানুষ হবে নিছক একটি বস্তুগত ও পার্থিব সত্তা, অতি প্রাকৃতিক উৎসমূল কিংবা পারলৌকিক পরিণতির সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই। তখন মানুষ তার বিবেচনা ও নির্ণয় শক্তি দ্বারা যা কিছুকে ভালো মনে করবে ও কামনা করবে সেটাই শুভ ও ভালো। আর যা কিছুকে অপছন্দ ও ঘৃণা করবে সেটাই মন্দ। অন্য কথায় বলা যায়, মানবের কামনা ও আকাঙ্ক্ষাই হবে ভালো ও মন্দ নির্ণয়ের এবং সকল নৈতিক মূল্যবোধ নিরূপণের সূচক। যেমনটা বেনথাম এ সম্পর্কে বলেন : ‘ভালো হচ্ছে যেটা চাওয়া হয় আর মন্দ হচ্ছে যেটা চাওয়া হয় না।’ এ কারণেই কিছু কিছু আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজে বিকৃত যৌনাচার, মাদকাসক্তি ও সমকামিতার মতো জঘন্য সংস্কৃতিও কোনো নৈতিকতা পরিপন্থি ও মন্দ কাজ হিসেবে পরিগণিত হয় না। তাদের কাছে কাপড় পরিধান করা অথবা না করা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়। কারণ, মন্দ কাজ হলো সেই কাজ যা ওই কাজের কর্তার কাছে ঘৃণ্য হবে এবং কর্তা তা করতে চাইবে না। কিন্তু যখন কোনো এক বা একাধিক কর্তা ওই কাজ করতে চায় কাজেই তা একটি ভালো কাজ হিসেবে পরিগণিত। বলা বাহুল্য, এহেন মাপকাঠির ভিত্তিতে কোনো কাজ অথবা সংস্কৃতি যত কুৎসিত ও নোংরাই হোক না কেন, যদি কারো চাওয়া ও কামনার পাত্র হয় তাহলে সেটা একটি ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হবে, যতক্ষণ না সেটা অন্যের স্বাধীনতার জন্য হানিকর হয়। সে কাজটি সম্পূর্ণরূপে একটি মানবতাবিরোধী ও শতভাগ একটি পাশবিক কাজই হোক না কেন। বাংলা ভাষায় সংস্কৃতির বিপরীত শব্দ অপসংস্কৃতি। যদি নৈতিকতা বিবোর্জিত মুক্তচিন্তা ও সংস্কৃতি দোষনীয় না হয় তবে অপসংস্কৃতি নামে কোনো শব্দেরই প্রয়োজন হতো না।

বস্তুত আমরা সংস্কৃতিকে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি : বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক। আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি হলো যা আপনার চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস, দর্শন, কথাবার্তা, নিয়মনীতি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত। আর বস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে খাবার পোশাক, দৈনন্দিন আচার ব্যবহার ইত্যাদি। মূলত ধর্ম বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় করে। আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির পুরোটাই ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটি প্রত্যেকের ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে বস্তুগত সংস্কৃতি নিজস্ব ধর্মীয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে পালন করতে বাধা নেই। যেমন : খাবার একটি বস্তুগত সংস্কৃতি কিন্তু শূকর ইসলামে হারাম এবং গো-মাংস হিন্দু ধর্মে নিষিদ্ধ। বাঙালি সমাজে ওয়াজ মাহফিল হাজার বছরের সংস্কৃতি অন্যদিকে পহেলা বৈশাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

এ দুটি সংস্কৃতি উভয় ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেই পরস্পর সাংঘর্ষিক। সম্প্রীতির মুখোশে হাজার বছরের দোহাই দিয়ে ধর্মাবলম্বীদের ওপর একজনের সংস্কৃতি অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কীভাবে মুক্তচিন্তা হতে পারে? বরং এর দ্বারা চিন্তার সংকীর্ণতাই প্রকাশ পায়।

তাদের ধারণা মানুষকে ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করতে পারলে সমাজে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি গড়ে উঠবে। মূলত তারা তথাকথিত আধুনিক সংস্কৃতি থেকে ধর্মহীনতার শিক্ষা নিলেও তার নৃশংসতা আঁচ করতে বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। প্রত্যেকে স্বধর্ম সমর্থিত সংস্কৃতি পালন সাম্প্রদায়িকতা নয় বরং এটিই সৌন্দর্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং পরস্পর সৌহার্দ্য প্রদর্শন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close