মোতাহার হোসেন

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

পরিবেশ

সমুদ্র দূষণ কমাতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

মানুষের ‘জীবন ও জীবিকা’র অন্যতম উৎস সমুদ্র। এই মহাসাগরগুলো পুরো বিশ্বকে পানি দেয়, প্রোটিন সরবরাহ করে। অর্থনীতি শক্তিশালী এবং কর্মসংস্থানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৪০ মিলিয়ন মানুষ সমুদ্রভিত্তিক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। মূলত আমদের জীবনে মহাসাগরের গুরুত্ব বোঝাতে প্রতি বছর জাতিসংঘ কর্তৃক ৮ জুন বিশ্ব মহাসাগর দিবস উদযাপন করা হয়। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাগর, মহাসাগরকে দূষণের হাত থেকে রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া উচিত। মনুষ্যসৃষ্ট বহুবিধ সমস্যায় প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে প্রকৃতি। প্রকৃতির এ জরাজীর্ণ অবস্থার জন্য মূলত আমরাই দায়ী। প্রকৃতির টিকে থাকার জন্য রক্তসঞ্চালনের মতো কাজ করে ‘জলাধার’। প্রকৃতির জন্য এটি একটি বিশেষ নিয়ামক। তাই পানির বৃহৎ আধার সমুদ্রকে বলা হয় ‘পৃথিবীর রক্তপ্রবাহ’। এ মহাসমুদ্রগুলোকে মহাভাগাড়ে পরিণত করার সম্পূর্ণ দায়ও আমাদের। অক্সিজেনের ৩০ শতাংশের জোগান আসে সমুদ্র থেকে, অথচ এই অক্সিজেন-ভা-ারকে আমরা প্রতিনিয়ত বিনষ্ট করে চলছি। গবেষণার তথ্য হচ্ছে, বছরে ২৫০ মিলিয়ন টন বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হচ্ছে সমুদ্রে। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়ে সমুদ্র বিপন্ন হচ্ছে। এ কারণে পানি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির পাশাপাশি বহু সামুদ্রিক প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটছে। হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে ‘ব্লু ইকোনমি’।

বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চল ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল সমুদ্র সীমার দূষণ ঠেকাতে না পারলে আমাদের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জলজ প্রাণিজগৎ বিপন্ন হবে, হুমকির মুখে পড়বে জলবায়ু, মানবসভ্যতা। সাম্প্রতিক সময়ে ডলফিন, তিমি, শুশুকসহ বৃহৎ আকৃতির সামুদ্রিক প্রাণীকে উপকূলের কাছাকাছি আসতে দেখা যায় এবং এসব প্রাণী অতিমাত্রায় প্লাস্টিক-দূষণের শিকার হচ্ছে। একইভাবে ভয়াবহ দূষণে রোগাক্রান্ত ও আহত অবস্থায় মরছে বিপুলসংখ্যক সামুদ্রিক জীব। দূষণমুক্ত করে এই ছোট্ট বদ্বীপকে আগলে রাখার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের বিপুল সমুদ্রসম্পদ তথা সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে সোনালি স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। এর আগে সমুদ্রবিজয় নিশ্চিত করে অমিয় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছি আমরা। বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চল বিপুল মৎস্যভা-ারসহ অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। তেল-গ্যাসসহ নানান খনিজসম্পদ সঞ্চিত রয়েছে সাগরের তলদেশে। এ গুরুত্ব অনুধাবন করে সমুদ্রাঞ্চলে দূষণ কমানোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। বিশ্বে মানবসৃষ্ট যতগুলো সমস্যা পৃথিবী ধ্বংসের কারণ হতে পারে, তার মধ্যে সমুদ্র দূষণ অন্যতম। অথচ এ বিষয়ে মানুষ একদমই উদাসীন। কয়েক দশক ধরে এই দূষণের মাত্রা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে মানুষ যে ইচ্ছাকৃতভাবে সমুদ্র দূষণ করছে তা নয়, বরং সভ্যতার উৎকর্ষ, অসচেতনতাই এর জন্য দায়ী। ব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ্যরে সবটুকু সমুদ্রে পতিত হয় না, কিংবা কোনো দেশই জাহাজ ভর্তি করে প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে না। বরং এর মূল উৎস হলো আমাদের বাড়ির পাশের নর্দমা, খাল, বিল ও নদী। যত্রতত্র ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বোতল ও ব্যাগের বড় একটি অংশ আশপাশের নর্দমায় পতিত হয়। সেগুলো নর্দমার পানিতে ভাসতে ভাসতে নদী-নালা হয়ে সমুদ্র গিয়ে জায়গা করে নেয়। এ কারণে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সমুদ্র সৈকতে আবর্জনার স্তূপ চোখে পড়ে। অন্যদিকে নদী-নালা ব্যবহার না করে সরাসরি সমুদ্রে অনেক কিছু নিক্ষেপ করা হয়। বর্তমানে মাছ ধরার নৌকা, প্রমোদতরী, তেলবাহী জাহাজ ও অন্যান্য জলযান সমুদ্রে সরাসরি বিভিন্ন দূষণকারী পদার্থ নিক্ষেপ করছে। পৃথিবীতে এই দূষণের দ্বারা প্রভাবিত নয় এমন জনপদ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এ কারণে সামুদ্রিক দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করা, দূষণ প্রতিরোধে বর্জ্যপদার্থ এবং অন্য বিষয়গুলোর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল কনভেনশনের লক্ষ্য। তারই ধারাবাহিকতায় কনভেনশনের সিদ্ধান্তগুলো আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার জন্য ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত হয় ‘লন্ডন প্রটোকল’। বাংলাদেশসহ ৫১টি রাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করে। ২০০৬ সালের ২৪ মার্চ থেকে ৫১টি রাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত লন্ডন প্রটোকল কার্যকর হয়।

সমুদ্রসম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বের বহু দেশ উন্নয়ন করছে। আমাদের দেশেও সমুদ্রসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে নেওয়া হয়েছে ‘শত বছরের বদ্বীপ’ পরিকল্পনা। পাশাপাশি সমুদ্র দূষণ রোধে টেকসই কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে করছে সরকার। দূষণ কমিয়ে সমুদ্রের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। গবেষণার তথ্য হচ্ছে, সমুদ্র দূষণের মাত্রা কমাতে না পারলে ২০৪০ সাল নাগাদ সমুদ্রে ৬০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হবে। বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটার সমুদ্রাঞ্চল দখল করে আছে ৫০ হাজার প্লাস্টিক বোতল। পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ১৪ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পতিত হয়। এ তথ্যের ভিত্তিতে এখন থেকেই সমুদ্রকে প্লাস্টিক বর্জ্যরে কবল থেকে পরিত্রাণে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৪ কোটি মানুষ সমুদ্রভিত্তিক শিল্পে যুক্ত হবে। এই সম্ভাবনার বড় অংশীদার বাংলাদেশ। উজ্জ্বল সম্ভাবনার এই বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার।

এটা সত্য যে, নদীদূষণের শেষ পরিণতি সমুদ্র দূষণ। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি শহর কোনো না কোনো নদীর তীরে অবস্থিত। প্রাচীনকাল থেকেই সেই শহরগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নির্ভরশীল ছিল পার্শ্ববর্তী নদীর ওপর। আর এটাই ছিল সবচেয়ে সহজ পন্থা। তবে যুগের পরিবর্তনে শহরগুলোতে উৎপাদিত বর্জ্যরে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে হাজার গুণ। বর্তমানে শহরগুলোর গৃহস্থালি ও কল-কারখানার বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসরণ এবং পয়োনিষ্কাশন করা হয় পার্শ্ববর্তী নদীতে। তবে নদীদূষণের মাধ্যমে সমুদ্র দূষণের দায় শুধু শহরগুলোর ওপর বর্তায় না। আধুনিক যুগে মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণের প্রধান মাধ্যম কৃষিকাজের রূপ ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক সার এবং অন্যদিকে রোগবালাই দমনে বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। আর সেচব্যবস্থাপনা, অতিবৃষ্টি ও বন্যার দরুন সেসব ক্ষতিকর পদার্থ নদী-নালায় পতিত হয়ে সমুদ্রে পৌঁছে যাচ্ছে। এ ছাড়া পৃথিবীর অনেক গবাদি পশুর খামার থেকে পশুর বর্জ্য ও মলমূত্র নদীতে ফেলা হয়। আর নদীতে এ ধরনের বর্জ্য অপসারণের ফলে সমুদ্রে ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। সাধারণত যেকোনো জলাধারে শৈবালের পরিমাণ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়াকে ইউট্রোফিকেশনের অন্যতম লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়। শৈবাল পানির উপরিভাগে স্তর তৈরি করে তলদেশে থাকা জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনচক্রে বাধা প্রদান করে।

কৃষিকাজে ব্যবহৃত সারের কারণে পানিতে ক্ষতিকারক নীল-সবুজ শৈবাল তৈরি হয়; এ থেকেও সমুদ্রে ডেড জোন সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু কৃষিকাজে ব্যবহৃত সারমিশ্রিত মাটি ও পানি নদীতে পড়ে সমুদ্রকে দূষণ করছে। অন্যদিকে শহরগুলো থেকে নদীতে নিষ্কাশিত দূষিত পানি ও ক্ষতিকর কেমিক্যাল অক্সিজেন ঘাটতি ঘটিয়ে ডেড জোন সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় চার শ ডেড জোন রয়েছে। তবে ঋতু পরিবর্তনে এদের অবস্থান ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। আবার তেল নিঃসরণের কারণেও সমুদ্রে ডেড জোন হতে পারে। গত কয়েক দশকে ঘটে যাওয়া তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনার মাধ্যমে পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্পষ্ট। এ ছাড়া সুন্দরবনের তেলবাহী কার্গো দুর্ঘটনাও সমুদ্র দূষণ হয়েছে। ২০১০ সালের ২০ এপ্রিলে মেক্সিকো উপসাগরে ডিপওয়াটার হরাইজন নামক একটি তেলের খনিতে সমুদ্রে তেল উত্তোলনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। প্রায় ৮৭ দিন ধরে আনুমানিক ৪ মিলিয়ন ব্যারেল তেল মেক্সিকো উপসাগরে পড়ে।

একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে প্রমোদতরীতে সমুদ্র ভ্রমণ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ভাসমান শহর হিসেবে আখ্যা পাওয়া এ ধরনের জাহাজ সাধারণত তিন থেকে সাত হাজার যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। তবে একটি শহরের নাগরিকদের মতোই এই জাহাজগুলোর যাত্রীদের দৈনন্দিন কার্যাবলির ফলে বিপুল পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা সৃষ্টি হয়। ১৯৪৬-৫৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরে তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক বর্জ্য সরাসরি নিক্ষেপ করেছে। এ ছাড়া সোমালিয়ার সমুদ্রতটে অবৈধভাবে পারমাণবিক বর্জ্য ও অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ নিক্ষেপ করেছে। অন্যদিকে সম্প্রতি জাপান সরকার ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রের দূষিত পানি প্রশান্ত মহাসাগরে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সমুদ্র এখনো পরিপূর্ণভাবে ভাগাড়ে পরিণত হয়নি। কিন্তু এভাবে সমুদ্র দূষণ চলতে থাকলে সমুদ্রের যতটুকু অঞ্চল দূষিত হয়েছে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সামুদ্রিক জীবের পাশাপাশি স্থলভাগের জীবনকেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। ‘সমুদ্র হচ্ছে পৃথিবীর শরীরের রক্তপ্রবাহ’। রক্তপ্রবাহ দূষিত হলে যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনি সমুদ্র দূষিত হলে পৃথিবী বাঁচবে না’। এই গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সমুদ্র দূষণ কমাতে স্থানীয়, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উদ্যোগ অপরিহার্য।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close