দেওয়ান রহমান

  ৩০ জুন, ২০২২

দৃষ্টিপাত

ঢাবি ভর্তি : পরীক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা

গত সোমবার ঢাবির মানবিক বিভাগ ‘খ’ ইউনিটের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রত্যাশা থাকা সত্ত্বেও এবারের পাসের হার অন্যবারের চেয়ে অনেক কম। ১৭৮৮টি আসনের বিপরীতে পরীক্ষা দিয়েছে ৫৬,৯৭২ জন। এদের মধ্যে পাস করেছে মাত্র ৫,৬২২ জন। আর পাসের হার হলো ৯.৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ ফেলই করেছে ৯০.১৩ শতাংশ প্রতিযোগী! এই ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র নাহনুল কবির নুয়েল। তার প্রাপ্ত নম্বর ৯৬.৫০ (১২০-এর মধ্যে)। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, যাদের প্রাপ্ত নম্বর মোটামুটি ৭০-এর আশপাশে থাকবে তারাই বিষয় নির্বাচনের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

এই হলো ঢাবির ‘খ’ ইউনিটের রেজাল্ট সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু উপাত্ত। যারা চান্স পেয়েছে ও যাদের চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি তারা নিশ্চয়ই পরিবারের সঙ্গে সময়টুকু সুন্দরভাবে উপভোগ করছেন। এরই মধ্যে ডায়েরি নিয়ে অনেকে হয়তো বসে গেছেন ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার মাঝখানের সময়টুকু কীভাবে কাটানো যায় তার ছক কষতে। আর যারা অকৃতকার্য হয়েছেন বা যাদের পজিশন অনেক দূরে তাদের কী অবস্থা!

আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা বর্তমানে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, প্রতিযোগিতা হওয়াটা ভালো কিন্তু অসুস্থ প্রতিযোগিতা নয়। যেই প্রতিযোগিতায় টিকতে ব্যর্থ হলে সমাজের ধিক্কার জোটে, প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ আর অনুত্তীর্ণ উভয়কেই বৈষম্যের শিকার হতে হয়। তাকেই আমরা বলব অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের মস্তিষ্কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্কে একটা ক্রমবাচক ও প্রতিযোগিতামূলক ট্যাগজুড়ে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান প্রথম, চট্টগ্রাম অথবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দ্বিতীয়। এভাবে একটা স্কোরিং করার রীতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। কিন্তু এই স্কোরিংটা কীভাবে হলো সেটাই প্রশ্ন। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কখনো কি এমন জরিপ বা প্রতিযোগিতা হয়েছে, যার কারণে একটি আরেকটির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের দাবিদার?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা এলে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ বিভিন্ন আলোচনা সামনে চলে আসে, যা শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পছন্দের শীর্ষে রাখতে বাধ্য করে। কিন্তু তার মানে এমন তো নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানেই উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা আর অন্যগুলো টিকে আছে নামমাত্র। প্রকৃতপক্ষে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান খুব কাছাকাছি। যদি কেউ কারো থেকে সামান্যতম এগিয়ে থাকে সেটা হচ্ছে ভৌগোলিক কারণে। কখনো পড়াশোনার মানদ- বা পরিবেশের কারণে নয়।

তাহলে কেন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বপ্ন হিসেবে বেছে নিয়ে মানসিক বিকৃতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রজন্ম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পেরে আত্মহত্যা করেছেন- এমন খবর প্রতি বছরই পত্র-পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসে। এ বছরও যে এমন সংবাদ আমাদের কানে আসবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ আমাদের শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থা সেভাবেই আমাদের তৈরি করে দিয়েছে। গত বছরের ১৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে নোহা (১৮) নামের এক শিক্ষার্থী। এর আগের বছর রাজধানীর ওয়ারীতে নাজমুল হাসান নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল। পরিবারের দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চান্স না পাওয়ার হতাশায় নাজমুল আত্মহত্যা করেছে। এমন সংবাদ গুগলে সার্চ করলেই অনেক পাওয়া যাবে। আত্মহত্যা ছাড়াও অনেকে হতাশা ও আত্মক্ষোভ থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, এমন নজির বাস্তবজীবনেও আমরা দেখেছি। এখন কথা হচ্ছে এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায় কী?

মাধ্যমিক থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে যে ভুল ও ক্ষতিকর তথ্যগুলো আমরা শিক্ষার্থীদের মগজে ঢুকিয়ে দিই সেগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জানতে হবে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য। শিক্ষা অর্জনের জন্য সঠিক পরিবেশ ও সঠিক মান শিক্ষার্থীর অধিকার, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কখনো শিক্ষা অর্জনের জন্য একমাত্র মাধ্যম হতে পারে না। ব্যক্তিগত উদাহরণ দেখাতে গেলে আমি বলতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই চান্স পেয়েছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া বিষয়টি আমার কাছে জ্ঞান অর্জনের জন্য তুলনামূলক ভালো মনে হয়েছিল বিধায় আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমি ছাড়াও এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে আর এ উদাহরণ আছে বলেই ওয়েটিং লিস্ট থেকে প্রতি বছর অনেকেই সুযোগ পাচ্ছে। শিক্ষার পরিবেশ ভালো থাকলে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েই অনেক ভালো কিছু করা যায়, সেটা হোক চাকরির ক্ষেত্রে বা অন্য যেকোনো কিছু। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পাঁচ বছরের জার্নি শেষে সব শিক্ষার্থীই এক কাতারে এসে দাঁড়াবে। তখন তারা কী, কতটুকু শিখেছে এবং তার প্রয়োগ করতে পারবে- এর ওপর ভিত্তি করেই তাদের কর্মজীবন নির্ধারিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ফলাফলে আবার ফিরে আসি। ফলাফলের দিন আমার অনেক জুনিয়র তাদের মার্কসশিটের ছবি আমার মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছিল। এদের মধ্যে কিছু জুনিয়রের ফলাফল ছিল খুবই করুন। তাদের কারো কারো প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৭৫-এর ওপরে, যা ভালো পজিশনে থাকার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু লিখিত বা নৈর্ব্যত্তিক অংশে ১ বা ২ নম্বরের জন্য ফেল করায় তাদের সব স্বপ্ন ভেস্তে গেছে। তাদের সান্ত¡না আর পরবর্তী পরীক্ষার জন্য অনুপ্রেরণা দেওয়া ছাড়া আমার কাছে কোনো অপশন ছিল না। অন্য যেসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমন হয়েছে এবং যারা অল্পের জন্য অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের উদ্দেশে বলব, নিজেদের ঢাবির অযোগ্য ভাবার কোনো কারণ নেই। এখানে যোগ্যরাই পরীক্ষা দিতে আসে। ভাগ্য সহায় হয়নি বলেই তোমরা ঢাবিতে পড়ার সুযোগ পাচ্ছো না। কিন্তু তোমাদের সামনে এখনো অনেক সুযোগ পড়ে আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার সুযোগ তো এখনো রয়েছেই? তা ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও তোমাদের জন্য উন্মুক্ত। পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা করে সব জায়গা থেকেই ভালো করা যায়।

এখনো ঢাবির ক, গ, ঘ ইউনিটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়া বাকি। আমার ওপরের লেখাগুলো সবার জন্যই প্রযোজ্য হবে। যারা কৃতকার্য হয়েছো তাদের জন্য অভিনন্দন রইল, আর যারা অকৃতকার্য হয়েছো তাদের বলব ‘নতুন করে শুরু করো’।

লেখক : শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close