আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ২৪ জুন, ২০২২

দৃষ্টিপাত

‘মাছ’ মহান আল্লাহর নেয়ামত

এ বছর বর্ষা আসার আগেই আকাশ থেকে নেমে আসা রিমঝিম বৃষ্টিতে আমাদের খাল-বিল ও পুকুর থেকে শুরু করে ছোট ছোট নদীগুলোও কানায় কানায় ভরে উঠেছে। আর পানি মানেই তো মাছের রাজত্ব। তাই বৃষ্টির এই পানির সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশীয় শিং, মাগুর, কৈ, টাকি, শোল, ট্যাংরা ও পুঁটিসহ নানা জাতের মাছের। সে কারণেই ঘরে বসে নেই সৌখিন মৎস্যশিকারিরা। প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই তারা নানা ফাঁদ নিয়ে নেমে যাচ্ছেন মাছ শিকারে। খাল-বিল আর নদী সর্বত্রই যেন আজ তাদের মিলনমেলা। এ মিলনমেলায় পিছিয়ে নেই ছোট ছোট শিশুও। আসলে মাছ যেন আমাদের রক্ত-মাংসে মিশে আছে। মিশে আছে আমাদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্বেও। সেজন্যই আমাদের পরিচয়, ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’।

মাছ আমাদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অশেষ নেয়ামত। মাছের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি অ্যাসিড; যা মানুষের মস্তিষ্ক, চোখ ও স্নায়ুতন্ত্র গঠনে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এ ছাড়াও আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রায় ৬০ শতাংশ প্রাণিজ আমিষের জোগান দেয় এই মাছ। মাছ শুধু যে আমাদের খাদ্যতালিকাতেই রয়েছে, তা কিন্তু নয়। মাছের চামড়া, হাড়, কাঁটা, চর্বি ইত্যাদি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার হয়। তাছাড়া শুশুক, হাঙ্গর প্রভৃতির তেল দ্বারা নানা ধরনের ওষুধ, বার্নিশ, গ্লিসারিন, সাবান ইত্যাদি তৈরি করা হয়ে থাকে। তাই সুস্থ-সবল ও মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে মাছের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্যই আল্লাহতায়ালা আমাদের জন্য এই অনন্য নেয়ামত তথা মাছের ব্যবস্থা করে রেখেছেন আমাদের সৃষ্টির বহু আগ থেকেই। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তিনিই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রকে; যাতে তা থেকে তোমরা তাজা গোশত (মাছ) খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পারো পরিধেয় অলংকার ... ’ (সুরা আন-নাহল, আয়াত : ১৪)।

আবার মাছ শুধু যে আমাদের রসনা তৃপ্ত করে তা নয়, বরং মাছ সাহিত্যের উপাদান হয়ে মানুষের হৃদয় ও মনকেও উজ্জীবিত করে। সে কারণেই কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে মাছ নিয়ে সাহিত্য রচনায় আগ্রহের কোনো কমতি নেই। মাছ নিয়ে এ যাবত রচিত হয়েছে অসংখ্য ছড়া-কবিতা, গল্প-উপন্যাস, শিশুতোষ রচনাসহ আরো বহু বাণী ও প্রবাদণ্ডপ্রবচন। বিখ্যাত লেখক মানিক বন্দোপাধ্যায় মাছ ও জেলেদের জীবন বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তুলেছেন তার ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে।

সমুদ্র হচ্ছে মাছের অভয়ারণ্য। সমুদ্র নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের ধারণা সমুদ্রের তলদেশে ২৩০০০০ প্রজাতিরও বেশি জীববৈচিত্র্য রয়েছে। আর এদের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে মাছ। এসব মাছ খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি পরিবেশবান্ধব। কারণ এ মাছগুলো সমুদ্রের পানির বিষাক্ত পদার্থ ফিল্টার করে। রক্ষা করে শোরলাইন রেড টাইডের মতো অ্যাগাম ব্লম প্রতিরোধ করে। সমুদ্র ছাড়াও নদীমাতৃক আমাদের এই বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা ইত্যাদি। সেসব নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবা, হাওর-বাঁওড়, নদীর মোহনা, উপকূল ও সমুদ্র অঞ্চল ইত্যাদিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।

আকার-আকৃতিতে এরা যেমন বিচিত্র, তেমনি নামগুলোও বেশ মজার। যেমন- বৌ মাছ, গুলশা, তপসে, চিতল, কাকিলা, কৈ, শিং, পাবদা আরো কত কী?

আমাদের দেশে দুই ধরনের মাছ পাওযা যায়। ১. স্বাদু বা মিঠা পানির মাছ ও ২. লোনা পানির মাছ। মিঠা বা স্বাদু পানির মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, আইড়, বোয়াল, পাঙাস, কালবাইশ, শোল, গজার, কৈ, মাগুর, মলা, চিংড়ি, পাবদা, তেলাপিয়া ইত্যাদি। আর লোনা পানির মাছ বলা হয় সামুদ্রিক মাছকে। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ইলিশ প্রধান। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। এ ছাড়াও রয়েছে লাক্ষা, রূপচাঁদা, চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, হাঙর, পোয়া, ভেটকি, কোরাল, বোয়াল ইত্যাদি। এসব মাছের মধ্যে বেশির ভাগ মাছই খাদ্য উপযোগী এবং হালাল।

হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আমরা সমুদ্রে বিহার করি। আমাদের সঙ্গে সামান্য পানি থাকে, তা দিয়ে যদি আমরা অজু করি, তাহলে সমুদ্র থেকে (এর পানি দিয়ে) কি অজু করব? রাসুল (সা) বলেছেন, ‘এর পানি পবিত্র এবং এর মৃত (মাছ) হালাল’- (তিরমিজি, হাদিস : ৬৯)। আমাদের দেশে যেসব মাছ পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে : বাইলা, বাইম বইটকা, ভেটকি, বালিচুরা, বামুশ, বাটা/বাংলা, বাতাসি, ভাদি পুঁটি, ভূত বিলচুরি, বেয়াল, চন্দন ইলিশ, চাপিলা, চেবলি, চেকা, চেপ চেলা, চেওয়া, চিতল, চুনোবেলে, ডাহুক, ডারি, দারকিনা, ঢাল মাগুর, গাংট্যাংরা, গুলসা, কাবাশি ট্যাংরা, ঘনিয়া, ঘর পোয়া, ঘোড়া চেলা, ঘোড়া মাছা, গিলি, পুঁটি, বেলে, গোটি পোয়া, গজার গুরা, ট্যাংরা, গুতুম, ইলিশ জয়া, কাঁচকি, কাজুলি, কাকিলা, কালিবাউশ, কানি পাবদা,

কানি ট্যাংরা, করাতি হাঙর, কাঁঠাল পাতা, কাতলা, খারু, খোরসুলা, কৈ, ইত্যাদি। এসব মাছ যেমনি আমাদের পুষ্টিসাধন করছে, তেমনি বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছে। দেশের রপ্তানি আয়ের ২ শতাংশের অধিক আসে এই মৎস্য খাত থেকেই।

মাছ আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতি ও উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সহায়তা করছে। বাংলাদেশের প্রায় মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। জাতীয় অর্থনীতিতে এ সম্ভাবনাময় সেক্টরের ভূমিকা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তবে আফসোসের কথা হচ্ছে, আমাদেরই কিছু অসাবধানতার জন্য আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ আজ চরম হুমকির মধ্যে আছে। হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রজাতির মাছ। আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশের কথাই ধরা যাক। ইলিশ যে আজ সোনার হরিণ। তাই আমাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু একসময় এই ইলিশ আমাদের কত সহজলভ্য ছিল, তা ভাবলে যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে, কিছু অসৎ লোকের দুর্নীতি। তাদের বিভিন্ন মিল-কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল দূষণ, মাছের বাসস্থান ধ্বংস এবং অতিরিক্ত হারে মাছ ধরার কারণেই অসংখ্য প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। তাছাড়াও আমাদের এই মৎস্যসম্পদ আজ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। যেমন : ১. মানুষ দিন দিন নদীনালা খাল-বিল ভরাট করে বাড়ি ঘর তৈরি করছে। ফলে মাছের আবাসস্থল ও বংশবৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটচ্ছে। ২. জমিতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে প্রচুর মাছ মারা যায়। ৩. নদী থেকে ডিমওয়ালা ও পোনাজাতীয় মাছ অপরিকল্পিতভাবে নিধন করা হচ্ছে। ৪. সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে প্রতি বছর বহু মাছ পচে যায়। ৫. দক্ষ লোকের অভাব।

এখনই এসব সমস্যা নিরসনকল্পে সরকার এবং আমাদের সবার সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আর এজন্য যা যা করা দরকার তা হচ্ছে, প্রতি বছর পানির অভাবে যেভাবে ব্যাপকহারে মাছ চাষ ব্যাহত হচ্ছে, তার সমাধনকল্পে সরকার সঠিক পানি সরবরাহের জন্য গঙ্গা ও তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি নিশ্চিত করা। এ ছাড়া পানি সংরক্ষণের জন্য নদী খননেরও ব্যবস্থা করতে হবে।

ডিমওয়ালা ও পোনা সংরক্ষণের জন্য নদী খননেরও ব্যবস্থা করতে হবে। ডিমওয়ালা ও পোনাজাতীয় মাছ ধরা থেকে আমাদের বিরত থাকা। নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরা থেকে সরে আসা। মাছ সংরক্ষণের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহনের ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি মৎস্য ব্যবসায়ীদের আধুনিক নিয়মাবলির শিক্ষা দেওয়া ও মৎস্য বিশেষজ্ঞ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপন করা।

জাতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং সর্বোপরি দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি, সমৃদ্ধি, প্রভৃতির কথা বিবেচনা করে আসুন আমাদের এই মৎস্যসম্পদের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করি এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকি। ফিরিয়ে আনি আমাদের হারানো গৌরব, আর হয়ে উঠি প্রকৃত ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’।

লেখক : খতিব ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close