সাহাদাৎ রানা

  ২১ জুন, ২০২২

দৃষ্টিপাত

আসুন বন্যার্তের পাশে দাঁড়াই

বন্যা আমাদের জন্য চিরচেনা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এবার সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভাসছে সিলেট। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে এখানে। সিলেট অঞ্চলের ৮০ ভাগ এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। সিলেট অঞ্চলে আকস্মিক বড় বন্যার কারণ মূলত বৃষ্টি। ভারতের মেঘালয় ও আসামে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে গত কয়েক দিনে। বিশেষ করে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার বৃষ্টি হয়েছে ৯৭২ মিলিমিটার। ১২২ বছরের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। মূলত এই বৃষ্টির কারণে সিলেট অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি। এমতাবস্থায় বন্যায় লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার পানিতে আটকে পড়ায় উদ্ধারের অপেক্ষায় আছেন অসংখ্য মানুষ। শুধু তাণ্ডই নয়, বন্যার পানির কারণে যাতায়াত ও যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কোথাও যাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। শুধু নৌযান ব্যবহার করে উদ্ধারকাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না নৌযান। এখন বন্যার্ত মানুষের জন্য জরুরি ভিত্তিতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা প্রয়োজন। বর্তমানে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা ভয়াবহ রূপ নিলেও আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা আরো ১৭ জেলায় বন্যা হতে পারে। তাই এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে। সরকারকে বন্যা মোকাবিলায় আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে প্রশাসনকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে। আর যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী বন্যার্তের পাশে দাঁড়াতে হবে।

বন্যার পানিতে আটকে পড়ে অনেক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কোনো কোনো এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অন্য যেকোনো সময়ের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এটা আমাদের জন্য সত্যিই ভয়ের কারণ। আর ভয়ের কারণ এখন প্রায় প্রতি বছরই বন্যার সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। কখনো ছোট আকারের বা কখনো ভয়াবহ আকারের বন্যা দেখছি। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে গত তিন দশকে এমন বন্যা আমাদের জন্য প্রায় নিয়মিত ঘটনা। আর এমন আকস্মিক বন্যা হওয়ার প্রধানতম কারণ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। এমন বিরূপ প্রভাবের বাইরে নই আমরা। প্রায় তিন দশক ধরে পৃথিবী জুড়ে সবচেয়ে আলোচিত হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি, যা দিন দিন আরো ব্যাপকভাবে আমাদের সামনে আসছে। এর একটাই কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষের জীবন ব্যবস্থায় নেতিবাচক পরিবর্তন লক্ষণীয়। বাংলাদেশও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছি প্রায় নিয়মিত।

বন্যা বিষয়টা আমাদের জীবনের সঙ্গে অনেকটা জড়িত। কারণ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় বন্যার সঙ্গে আমাদের দেশের অর্থনীতির বৈরী সম্পর্ক। কৃষকদের উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে আমাদের অর্থনীতি সব সময় চলমান থাকে। অধিক উৎপাদন আমাদের অর্থনীতিকে রাখে গতিশীল। তাই বন্যায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাস্তবিক অর্থে ক্ষতি হয় দেশের। বলতে দ্বিধা নেই, এ সময় আমাদের কাছে বন্যা সমার্থক হয়ে গেছে। অথচ বন্যার নেপথ্যে রয়েছে মানবসৃষ্ট কিছু কারণ। এখন বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে পরিবেশের ওপর। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতুবৈচিত্র্য ও বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে। এমন প্রভাবে আমরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। লক্ষ করা যাচ্ছে, উষ্ণতা বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেরুদেশের বরফ গলে যাওয়ায় বাড়ছে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা। এ ছাড়া এর সঙ্গে প্রতি বছর যোগ হচ্ছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপমাত্রার আকস্মিক এবং ব্যাপক ওঠানামাসহ নানা অস্বাভাবিক সব পরিস্থিতি। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের।

প্রকৃতির এই খেয়ালিপনায় শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই জনজীবন নানাভাবে প্রভাবিত ও বিঘিœত হচ্ছে। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জীবনকে বিধ্বস্ত করে তুলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের এই স্বাভাবিক চিত্রটি বাস্তবিকই অনেকখানি বদলে গেছে। শুধু বাংলাদেশ বললে ভুল হবে, বিশ্বের অনেক দেশেই এর প্রভাব বিদ্যমান। উপরন্তু বাংলাদেশের ইদানীংকালের জলবায়ুতে পরিবর্তনও দৃশ্যমান। এখন প্রশ্ন হলো বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? সহজ কথায়, উপায় আমাদের কাছেই। মানুষের কারণেই যেহেতু বৈশ্বিক পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে তাই মানুষের কাছেই রয়েছে এর সমাধান। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন মানুষের ব্যাপক সম্পৃক্ততা। সবার সচেতনতা। সর্বোপরি সবুজের বিকল্প নেই। কেননা, ব্যাপক বনায়ন পারে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে আমাদের রক্ষা করতে। কারণ বাংলাদেশে যে পরিমাণ বনায়ন থাকার কথা এর বিপরীতে আছে খুব সামান্য। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাই ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত মোকাবিলায় উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বনায়ন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। পাশাপাশি সমুদ্রের লবণাক্ত পানি যাতে কুল ছাপিয়ে মিঠাপানিতে মিশতে না পারে সেজন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ, পানিদূষণ প্রতিরোধ করার পাশাপাশি এর নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষির ওপরও। এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষিজীবীরা কীভাবে খাপ খাওয়াতে পারেন সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা। কিন্তু কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি। তাই কৃষকদের বিষয়টি বিশেষভাবে মাথায় নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ কৃষকরা সঠিকভাবে তাদের কাজ করতে পারলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবে দেশ। বন্যা শেষ হলে কৃষকদের সামনে আসে নতুন চ্যালেঞ্জ। কৃষকরা যাতে সেই চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হতে পারে সে বিষয়ে সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

বাস্তবতা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কার্বন নিঃসরণ বিশেষ অনুঘটক হচ্ছে। এজন্যই এর বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে সবুজের বিকল্প নেই। কেননা, ব্যাপক বনায়নই পারে কার্বন নিঃসরণ রোধ করে প্রকৃতির বৈরিতা থেকে আমাদের অনেকাংশে রক্ষা করতে। কারণ বাংলাদেশে যে পরিমাণ সবুজ থাকার কথা এর বিপরীতে আছে সামান্যই। কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে প্রকৃতিকে প্রকৃত বন্ধু করে তুলতে পারাটাই হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এজন্য প্রয়োজন আমাদের চারপাশকে সবুজে শ্যামল করে তোলা। তবেই আমরা বন্যার হাত থেকে অনেকটা রক্ষা পেতে পারি। আর নিরাপদ রাখতে ও দুর্যোগ হ্রাসের জন্য ব্যাপক বনায়নের প্রতি সবার মনোযোগী হওয়া বেশি প্রয়োজন। এখন বর্ষা মৌসুম। গাছ লাগানোর সময়। তাই এ সময় বেশি করে সবাইকে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। অবশ্য নির্দিষ্ট একটি সময়ে নয়, সারা দেশকে সবুজে রূপান্তরিত করতে বছরজুড়েই বৃক্ষরোপণ করতে হবে। কারণ বৃক্ষরোপণই পারে প্রকৃতির প্রতি সহমর্মিতা সৃষ্টি করতে। যার ফলে সম্ভব দুর্যোগ হ্রাস।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close