রেজাউল করিম খোকন

  ১৯ জুন, ২০২২

দৃষ্টিপাত

অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি

এখন চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভিনদেশি উন্নত জাতের আমের সফল উৎপাদন হচ্ছে। ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, পাকিস্তানের উন্নতজাতের আম উৎপাদন করে সফল হয়েছেন স্থানীয় আমচাষি এবং বেশ কি এগ্রো প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক অবস্থায় স্থানীয় আমচাষি, এগ্রো প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে বান্দরবান, লামা, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কাপ্তাইসহ বিভিন্ন এলাকায় আবাদ করে পরীক্ষামূলকভাবে উন্নতমানের আমের চাষ শুরু করে প্রায় ২৩ বছর আগে থেকে। চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলো উন্নতজাতের আম চাষের উপযোগী হওয়ায় আমচাষিরা লাভের মুখ দেখতে পায়। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে উঠে অসংখ্য আমের বাগান। বর্তমানে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার আমের বাগান রয়েছে। এসব বাগানে প্রায় ৩০ হাজার লোক কর্মরত। বিভিন্ন এগ্রো প্রতিষ্ঠান পার্বত্য অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ এগিয়ে আসায় এটি বর্তমানে একটি সম্ভাবনাময় লাভজনক, সম্ভাবনায় কৃষি এবং শিল্প উদ্যোগে পরিণত হয়েছে।

১৯৯৭ সাল থেকে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আমের মধ্যে রয়েছে আম্রপালি, মল্লিকা, রাংগুয়াই, হাঁড়িভাঙা, থাই কাঁচামিঠা, থাই নাম ডাকমাই, ফনিয়া, থাই ব্যানানা জাতের আম। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে উন্নত জাতের আম্রপালি চাষ করে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছেন স্থানীয় আমচাষিরা। আমাদের দেশে এখন আমের মৌসুম চলছে। অতুলনীয় ও ভিন্ন স্বাদের পাহাড়ি বিদেশি জাতের আম এরই মধ্যে বাজারে চলে এসেছে। চট্টগ্রাম শহরসহ রাজধানী ঢাকার বাজারেও মিলছে দেশের পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত এসব বিদেশি জাতের আম। বেশ কয়েক বছর ধরে রাজশাহী অঞ্চলের আমের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করেছে তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত উন্নত মানের বিদেশি সুস্বাদু আম। বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং প্রান্তিক পর্যায়ের বহু উদ্যোক্তা-চাষি পাহাড়ে আমের আবাদ করছেন। তিন পার্বত্য জেলায় খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের মধ্যে বেশির ভাগ আম বাগান রয়েছে বান্দরবানে। এখানেই রয়েছে কৃষিভিত্তিক বড় এগ্রো ফার্মগুলোর ফলের বাগান।

পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আমগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে খুব মিষ্টি, সুস্বাদু, আঁশবিহীন, ছোট আঁটিযুক্ত। এসব আম ভারতীয় আমের তুলনায় উন্নত হওয়ায় ক্রেতারা এসব আমের প্রতি ঝুঁকছেন। দিন দিন এসব আমের চাহিদা শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে এত ব্যাপক পরিমাণে আম উৎপন্ন হচ্ছে, যা শিল্পের রূপ নিতে যাচ্ছে। রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান, লামা, খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি, মাটিরাঙাসহ তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট-বড় বহু আমের বাগান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ভিনদেশি সুস্বাদু উন্নতমানের আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে মেরিডিয়ান এগ্রো। তাদের উৎপাদিত আমের মধ্যে রয়েছে ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভিয়েতনামি জাতের আম। মেরিডিয়ান এগ্রো সর্বমোট ৩২ জাতের আমের চাষ করে যাচ্ছে। তারা ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে ভারত থেকে চারা এনে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে আম্রপালি জাতের আমের চাষ শুরু করেছিল। আম্রপালি ভারতীয় জাতের আম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি আমণ্ড৩ জাত হিসেবে আম্রপালিকে অবমুক্ত করেন। প্রথমপর্যায়ে এই আমের জাতের চারার সংকটের কারণে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত থেকে ১৯৯৬ সালের দিকে এই আম্রপালি আমের চারা আমদানি করে এবং কৃষকপর্যায়ে বিনা মূল্যে বিতরণ করে। আম্রপালি আমের চাষ চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে বান্দরবান, লামা, খাগড়াছড়ি, রামগড়, কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা এলাকায় বেসরকারি উদ্যোগে আম্রপালি আমের চাষ করা হচ্ছে। মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে আম্রপালি আমের মুকুল আসে। জুন-জুলাই মাসের দিকে ফলন আসে। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে চারা রোপণের তিন বছরের মধ্যে গাছে ফলন আসা শুরু করে। প্রথমপর্যায়ে গাছ ছোট থাকায় গড়ে গাছপ্রতি পাঁচ থেকে ছয় কেজি আম উৎপন্ন হয়। পর্যায়ক্রমে গাছের বর্ধনের পর গাছপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ কেজি আম উৎপন্ন হয়। আম্রপালি আম উৎপাদনের জন্য চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের মাটি এবং আবহাওয়া খুবই উপযোগী। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে প্রতি আমের মৌসুমে ১৫ থেকে ২০ হাজার টন আম্রপালি আম উৎপন্ন হচ্ছে। এই পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক ভিত্তিতে আম্রপালি আমের চাষ করলে দেশে আমের সংকট দূর হবে এবং বিদেশে আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে। বিদেশ থেকে আম আমদানি বন্ধ হয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।

তথ্য মতে, সুস্বাদু ও বছরের ৪-৫ মাস ধরে স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায় বলে ভিনদেশি আমের চাহিদা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের আমের বাজারের সঙ্গে বেশ দাপটের সঙ্গেই পাল্লা দিচ্ছে পাহাড়ে উৎপাদিত ভিনদেশি নানা জাতের আম। আমের মৌসুমে প্রতিটি আমগাছ থেকে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি আমের ফলন পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এসব আম অত্যন্ত সুস্বাদু, মিষ্টি, আঁশবিহীন, পাতলা আঁটির চামড়াও বেশ পাতলা। ঘ্রাণও দারুণ এবং অতুলনীয় বলা যায়। আমাদের এখানকার ক্রেতাদের মধ্যে পার্বত্য জেলার উৎপাদিত বিদেশি নানা জাতের আমের ব্যাপারে তুমুল আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা এসব আম এর আগেই খেয়ে পরিতৃপ্তি লাভ করেছেন। ফলে তারা বাজারে এসে পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত আমের খোঁজ করছেন। উৎপাদিত ভিনদেশি বিভিন্ন জাতের এসব আম বর্তমানে চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরের সুপারশপ ছাড়াও বিভিন্ন এগ্রো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইনেও এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইনেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আম কেনার চমৎকার সুযোগ রয়েছে। এখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা অনলাইনে যোগাযোগ করে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আম কিনছেন। অতিরিক্ত খরার কারণে এবার আমের উৎপাদন সন্তোষজনক পরিমাণে হয়নি।

পার্বত্য অঞ্চলে উন্নত জাতের আম উৎপাদনে আমচাষিদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচেছ। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে আম উৎপাদনে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, পর্যাপ্ত কীটনাশকের অভাব, সারের অভাব, দুর্গম পাহাড়ে যাতায়াতের অসুবিধা, বিদ্যুৎ সমস্যা, কৃষিঋণের দুষ্প্রাপ্য, বাজারজাতকরণ সমস্যা, সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব, আম প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যা। আম সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত আম পচে নষ্ট হয়ে যায়। এতে আমচাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমচাষিরা আমের ন্যায্য দাম পায় না। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা না থাকায় প্রতি বছর হাজার হাজার টন আম পচে নষ্ট হয়ে যায়। আমচাষিরা এবারও আম নষ্ট হওয়ার সমস্যায় ভুগছেন। আমচাষিদের প্রধান দাবি, পার্বত্য অঞ্চলে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে তোলা। এ ব্যাপারে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ আশা করছেন আমচাষিরা। পার্বত্য অঞ্চলে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠলে আমের অপচয় কমবে। আমচাষিরা আম উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্য পাবেন। সরকার ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পার্বত্য অঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমের বিভিন্ন প্রোডাক্ট তৈরি করতে পারেন। এতে সবাই উপকৃত হবেন। চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলায় হিমাগার (কোল্ড স্টোরেজ) নির্মাণ করা গেলে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আম সারা বছর ধরে খেতে পারবে মানুষ। পাহাড়ি এলাকার আমচাষিদের জন্য স্বল্প খরচে পরিবহন সুবিধা ও সহজশর্তে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করা গেলে পাহাড়ি এলাকায় আম উৎপাদনে দারুণ এক বিপ্লব ঘটতে পারে। আমের জুস প্রক্রিয়াকরণসহ আমের বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরির কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত আমের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানো যায়। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে উন্নতজাতের আম উৎপাদনে সরকারের পক্ষ থেকে কারিগরি সহযোগিতা প্রদান, স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা, উন্নত যোগাযোগের ব্যবস্থা বিদ্যুতের ব্যবস্থা এবং আম সংরক্ষণের ব্যাপারে উপয্ক্তু ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমাদের দেশ আম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে। আমের জন্য আর বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হবে না। উন্নতজাতের আম চাষ এবং উৎপাদন একটি লাভজনক, সম্ভাবনায় কৃষি উদ্যোগ এবং শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close