মো. আরাফাত রহমান

  ২২ মে, ২০২২

দৃষ্টিপাত

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অপরিহার্য

জীববৈচিত্র্য উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসহ পৃথিবীর পুরো জীবসম্ভার সমন্বয়ে গঠিত বাস্তুতন্ত্র। তিনটি বিভিন্ন পর্যায়ে এগুলো বিবেচ্য : বংশানুগত বৈচিত্র্য, প্রজাতি বৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য। বংশানুগত বৈচিত্র্যের মাত্রা সংখ্যায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। এটি প্রজাতি বৈচিত্র্য অপেক্ষা বহু গুণ অধিক। প্রজাতি পর্যায়ে বৈচিত্র্য সম্পর্কেও সম্পূর্ণ তথ্য জানা যায়নি। বিজ্ঞানীদের নানা হিসাব মোতাবেক প্রজাতি সংখ্যা ১ কোটি থেকে ১ দশমিক ৫ কোটি। এর মধ্যে প্রায় ১৪ লাখ শ্রেণিবিন্যস্ত হয়েছে এবং তাতে আছে প্রায় ২,৫০,০০০ উদ্ভিদ, ৭,৫০,০০০ কীটপতঙ্গ, ৪১,০০০ মেরুদণ্ডী, বাকিরা অন্য অমেরুদণ্ডী, ছত্রাক, শৈবাল ও অণুজীব। এখনো অনেক প্রজাতি অনাবিষ্কৃত রয়েছে। এ বৈচিত্র্যের অধিকাংশই রয়েছে পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলে, আর্দ্র-উষ্ণ এলাকায়, বিশেষত বনাঞ্চলে।

বিশ্বজুড়ে জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর ২২ মে পালিত হয় বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস। জীববৈচিত্র্য প্রজাতি বিলুপ্তি ঠেকাতে সহায়তা জোগায়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক চুক্তিতে দেড় শতাধিক দেশের প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশও এ চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী। উদ্ভিদ উর্বর পলিমাটির জমি এবং উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে খুবই সমৃদ্ধ। এ দেশে উদ্ভিদের প্রজাতি সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি, এর মধ্যে ৩০০ বিদেশি ও ৮টি একান্ত দেশীয়। বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত ৯৫ প্রজাতির ৯২টি আবৃতবীজ, ৩টি নগ্নবীজ। স্বাদু ও লোনা পানিতে আছে ২২৪৪ প্রজাতির শৈবাল ও তাদের জাত।

বাংলাদেশে আছে প্রায় ২২ প্রজাতির উভচর, ১০৯ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ ও ১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির আবাসিক ও ২৪০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এবং ১১০ প্রজাতির অন্তর্দেশীয় ও ৩ প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। এমন ছোট একটি দেশে বন্যপ্রাণীর এরূপ অপূর্ব সমাবেশ এবং বৈচিত্র্য এক আশ্চর্য ঘটনা, যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। তবে এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ; অসংখ্য নদণ্ডনদী, খাল-বিল, ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চল এবং মনোরম জলবায়ু বহু যুগ ধরে বাংলাদেশকে বিচিত্র বন্যপ্রাণীর অনবদ্য আবাসস্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে দেশের অন্তর্দেশীয় ও আবাসিক ৮৯৫ প্রজাতির (২৬৬টি স্বাদুপানি ও স্বল্পলোনাপানির মাছসহ) মধ্যে ২০১ প্রজাতি বিভিন্ন ধরনের হুমকির সম্মুখীন এবং ২২৩ প্রজাতির অবস্থা অনিশ্চিত ও আশঙ্কাজনক।

বিগত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে এক ডজনের বেশি বন্যপ্রাণী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এক শিংয়ের গ-ার, জাভান গ-ার, এশিয়ান দুই শিংয়ের গ-ার, গাউর, বেন্টিং, বুনো মহিষ, হরিণ, নীলগাই, নেকড়ে, নুকতা হাঁস, ময়ূর এবং বাদার কুমির। যেহেতু অধিকাংশ বন্যপ্রাণী প্রধানত বনাঞ্চলের ধরন, অবস্থা এবং বিস্তৃতির ওপর নির্ভরশীল, এসব প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি তাই স্থানীয় ও আবাসিক পশুপাখিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে বনাঞ্চলের অবনতি ঘটেছে প্রচণ্ডভাবে। অনুমান করা হয় যে ১৯৭০ শতক থেকে বনভূমির পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগের বেশি হ্রাস পেয়েছে।

বাংলাদেশের পাখি প্রজাতির সারস সবচেয়ে বড় পাখি, উচ্চতা হয় প্রায় ১.৭ মিটার। তবে এ পাখি এখন বিরল, কদাচিৎ দেখা যায়। কিছু মধুপায়ী ও সানবার্ড দৈর্ঘ্যে মাত্র ৭-৮ সেমি। সম্ভবত বাংলাদেশে এরাই পাখিদের মধ্যে ক্ষুদ্রতম। বনভূমির অবনতি ও অবক্ষয় এবং সেই সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন নিঃসন্দেহে পাখিসম্পদকে দারুণভাবে প্রভাবিত করছে। বনাঞ্চল ও জলাভূমির সঙ্গে সম্পৃক্ত বহু পাখির সংখ্যা এখন কমে গিয়েছে। অধিকাংশ পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে এ উপমহাদেশের উত্তর অঞ্চলের পার্বত্য এলাকা থেকে। কিছু আসে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল ও সাইবেরিয়া থেকে। অনেক প্রজাতি দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার দেশগুলোতে তাদের অভীষ্ট স্থানে পৌঁছানোর আগে যাত্রাপথে বাংলাদেশে কিছু সময়ের জন্য বিরতি নেয়। আবার অনেক পরিযায়ী পাখিই শরৎ ও বসন্তকালে বাংলাদেশেই অবস্থান করে, তারপর নিজের দেশে ফিরে যায়।

১৯২৭ সালের ভারতীয় বন-বিধিতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এতে অবশ্য বনসম্পদের সংজ্ঞা দিতে সব বন্যপ্রাণী এবং চামড়া, দাঁত, শিং, হাড়, রেশম, গুঁটি, মধু, মোম ইত্যাদির উল্লেখ ছিল। ব্রিটিশ আমলে প্রয়োজনবোধে বন্যপাখি ও অন্যান্য প্রাণী অথবা কোনো নির্দিষ্ট প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি বিশেষ আইন ও বিধি চালু ছিল। এগুলো হলো : ১. বন্যহাতি সংরক্ষণ আইন, ১৮৭৯; ২. বন্যপাখি ও জন্তু সংরক্ষণ আইন, ১৯১২; এবং ৩. বন্য গ-ার সংরক্ষণ আইন, ১৯৩২। এসব আইন ছাড়াও ভারতীয় বন-আইন, ১৯২৭ ও অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ সরকারের কাছে শিকার ও মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে, যা প্রয়োজনবোধে প্রযোজ্য। পরে ১৯৫৯ সালে সরকার ব্যক্তিগত ও সরকারি বনে এসব কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য পৃথক দুই প্রস্থ আইন তৈরি করে।

১ম শ্রেণি : কোনো বিশেষ প্রজাতির অবলুপ্তি রোধের জন্য কিংবা অভয়ারণ্য বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এসব বনে সব ধরনের শিকার, ফাঁদণ্ডপাতা বা মাছ-ধরা নিষিদ্ধ, যত দিন না একটি প্রজাতি বৃদ্ধি পেয়ে অন্যান্য সম্পদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

২য় শ্রেণি : এ ধরনের বনে এসব আইন মোতাবেক বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বা অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই শুধু শিকার, ফাঁদণ্ডপাতা বা মাছ ধরতে পারবে।

এসব আইন বন্যপ্রাণী রক্ষায় ততটা কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি। ফলে, বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ২৩, ১৯৭৩ হিসাবে ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আদেশ ১৯৭৩’ জারি করে। অতঃপর ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) বিধি, ১৯৭৪’ হিসেবে ১৯৭৩ সালের এই আইন সংশোধিত, সম্প্রসারিত ও পুনঃবিধিবদ্ধ হয়। সংশোধিত বিধিতে আছে ৪৮ ধারা ও ৩ তফসিল। এতে রয়েছে : বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা পরিষদ গঠন, অভয়ারণ্য, জাতীয় পার্ক ও শিকারভূমি প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা; আইনভঙ্গকারীর জন্য জরিমানা ও শাস্তি; বন্যপ্রাণী আমদানি ও রপ্তানি; ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন; সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং এই আইনের ভিত্তিতে বিধিবিধান প্রণয়ন। এটি ১৮৭৯, ১৯১২ ও ১৯৩২ সালের আইনগুলোও বাতিল করে। এই তফসিলে বন্যপ্রাণীর একটি তালিকা রয়েছে, তাতে অন্তর্ভুক্ত যেগুলোর শিকার অনুমতি সাপেক্ষে বৈধ; যেসব প্রাণী এবং তাদের সংরক্ষণযোগ্য অংশ ও মাংস রাখা, হস্তান্তর ও ব্যবসার জন্য অনুমতিপত্র প্রয়োজন।

প্রথম তফসিলে রয়েছে উভচর ৩, সরীসৃপ ৩, পাখি ২৭ ও স্তন্যপায়ীর ৩ প্রজাতি। কাঁকড়াও এতে অন্তর্ভুক্ত। এ তফসিলে বর্ণিত প্রাণী সাধারণ অনুমতিপত্র নিয়েই শিকার করা যাবে। প্রথম তফসিলের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী শিকারের জন্য বিশেষ অনুমতিপত্র আবশ্যক, অর্থাৎ এসব প্রাণীর মধ্যে মানুষখেকো বাঘ, বন্যহাতি ইত্যাদির সংখ্যা বৃদ্ধি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটালে কিংবা জান ও মালের জন্য হুমকি হয়ে উঠলে এ ধরনের অনুমতিপত্র পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় তফসিলভুক্ত প্রাণীদের সংরক্ষণযোগ্য অংশ, মাংস বা চামড়া আইনসিদ্ধ অনুমতিপত্র ব্যতিরেকে রাখা অবৈধ। এতে আরো রয়েছে ১৮ সরীসৃপ, ৪৬১ পাখি ও ৬৭ স্তন্যপায়ী প্রজাতি যেগুলো শিকার, হত্যা বা ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই তফসিল মোতাবেক গর্ভবতী, দুগ্ধদাতা ও শাবকসহ মা-পশুদের শিকার নিষিদ্ধ। তফসিলের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সব প্রাণীর স্ত্রী-পশু বিপজ্জনক ঘোষিত (মানুষখেকো বাঘ, বন্যহাতি ইত্যাদি) না হলে শিকার করা যাবে না।

১৯৭৪ সালের আইন ১৯২৭ সালের বিধি ও সংশ্লিষ্ট নিয়মকানুনের সঙ্গে এর সম্পর্ক উল্লেখ করেনি। ১৯২৭ সালের আইনের প্রাসঙ্গিক ধারাগুলোও এতদ্বারা বাতিল হয়নি। বলা যেতে পারে, ১৯৭৪ সালের আইন একটি স্থায়ী বিধি হিসেবে ১৯২৭ সালের আইনের যাবতীয় বিধিবিধান রহিত করেছে। ১৯৭৪ সালের আইনটি অবশ্য সর্বাঙ্গীন নয়, যথেষ্ট পূর্ণাঙ্গও নয়, তাতে বাদ গেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উপযুক্ত লোকবল, অর্থবল ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে উল্লিখিত বিধিগুলোও যথাযোগ্যভাবে প্রয়োগ করা যায় না। আইনটির প্রয়োজনীয সংশোধন আবশ্যক বলে বিশেষষ্ণদের ধারণা।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের ১৮-ক অনুচ্ছেদে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদ (ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ইরড়ষড়মরপধষ উরাবৎংরঃু)-এর পক্ষ হিসেবে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উহার উপাদানসমূহের টেকসই ব্যবহার, জীবসম্পদ ও তৎ?সংশ্লিষ্ট জ্ঞান ব্যবহার থেকে প্রাপ্ত সুফলের সুষ্ঠু ও ন্যায্য হিস্যা বণ্টন এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে বিধান করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।

বাংলাদেশ বন ও বনসম্পদণ্ডসংশ্লিষ্ট কয়েকটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন, চুক্তি ও প্রটোকলের স্বাক্ষরদাতা। এগুলোর কোনো কোনোটি অনুমোদিত না হলেও স্বাক্ষরিত হওয়ার সুবাদে এগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পক্ষে ক্ষতিকর সব ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। আমরা প্রকৃতির, প্রকৃতিও আমাদের। সুন্দর এই প্রকৃতি ও পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। সে দায়িত্ব শুধু যে জীববৈচিত্র্যের জন্য তা নয়, কেনো না কোনোভাবে মানুষের অস্তিত্বের জন্যই জীববৈচিত্র্য রক্ষা জরুরি।

লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল

ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close