আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ২০ মে, ২০২২

দৃষ্টিপাত

রহস্যঘেরা চাঁদের কথা

কাজল কালো রাতের আকাশে অজস্র তারকার মাঝখানে রুপার থালার মতো উজ্জ্বল যে বস্তুটি রাতভর তার স্নিগ্ধ আলোয় এই পৃথিবীকে আলোকিত করে রাখে তার নাম চাঁদ। চাঁদকে চিনে না এমন মানুষ নেই। চাঁদকে আমরা অনেক নামেই চিনে থাকি। এই যেমন- চন্দ্র, চন্দ্রিকা, শশীকর ইত্যাদি। ইংরেজিতে চাঁদকে বলা হয় মুন। আর পবিত্র কোরআনে চাঁদের নাম রাখা হয়েছে কামার। কামার নামে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা একটি সুরাও নাজিল করেছেন। নতুন চাঁদকে আবার আরবি ভাষায় অবহিত করা হয় হেলাল বলে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় চাঁদকে বিভিন্ন নামে ডেকে থাকে।

সত্যিই, চাঁদ আমাদের সবার কাছে অতি আদর মাখা একটি নাম। একজন মা যেমন তার সন্তানকে আদর করতে গিয়ে বলেন, ‘ওলে আমার চাঁদের কণা’ তেমনি একজন প্রিয়তমও তার প্রিয়তমার উপমা খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই বেছে নেয় নির্মল চাঁদকে। ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষটিকে বলে চন্দ্রমুখী। দিগল রজনির শব্দহীন প্রকৃতিকে চাঁদ যখন তার নির্মল আলোর

মোহনীয় করে তুলে, তখন সে রূপমাধুরীর কোমল পরশে মনের গহিনে উছলে ওঠে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। পৃথিবীতে এমন লোকের সংখ্যা খুব কমই হবে, যাদের চিত্ত চাঁদের মায়াবী জোৎস্ননায় ব্যাকুল হয়ে উঠেনি।

চাঁদের রূপ-রহস্য নিয়ে আমাদের মাঝে যেমন ভাবনার কূল নেই, তেমনি এর সৃষ্টি তথ্য নিয়ে মত-দ্বিমতের শেষ নেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, চাঁদ পৃথিবীরই একটি অংশ। মহাবিস্ফোরণের ফলে এর জন্ম হয়েছে। তারা মনে করেন, চাঁদ তৈরি হয়েছে একটা ছোটো গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর ধাক্কা লাগার কারণে। এই সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর যে ধ্বংসাবশেষ হয়েছে, সেই ধ্বংসাবশেষগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। ঘুরন্ত সেই মেঘগুলোই এক পর্যায়ে জমাটবদ্ধ হয়ে চাঁদে পরিণত হয়েছে।

এত গেল বিজ্ঞানীদের কাল্পনিক থিউরি। এবার চলুন দেখি, এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন কী বলে? চাঁদের উৎস, বৈশিষ্ট্য এবং সৃষ্টির রহস্য নিয়ে ইতোপূর্বে মানুষের যত জল্পনা কল্পনা আর ভ্রান্ত ধারণা ছিল, সেসব ভ্রান্ত ধারণার নিরসনে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘কল্যাণময় তিনি, যিনি নভোমণ্ডলে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে রেখেছেন সূর্য ও দীপ্তিময় চন্দ্র।’ (সুরা আল ফুরকান : ৬১)

চাঁদকে কেন্দ্র করে মানুষের মাঝে কুসংস্কারের যেন শেষ নেই। প্রাচীনকালের মানুষরা মনে করতেন, চাঁদে একটা মানুষ আছে, আর সে মানুষটি প্রায় চাঁদের সমান বড়। আবার কিছু মানুষ মনে করত, চাঁদ প্রত্যেক রাতে মরে গিয়ে ছায়ার জগতে মিলে যায়। কেউ কেউ মনে করত সূর্য আর নক্ষত্রের মতো চাঁদও তাদের আরেকটি দেবতা। তাই চাঁদকে তারা নাম দেয় চন্দ্রদেব। চন্দ্রদেবের নামে শুরু হয় পূজা অর্চনা। রচনা করা হয় নানা কল্প-কাহিনি। অথচ যিনি এই চাঁদেরও স্রষ্টা, যার হুকুমে চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধি, সেই পরাক্রমশালী আল্লাহকেই ভুলে গেল তারা।

চাঁদের গায়ের কালো কালো দাগগুলো নিয়ে আমাদের মাঝেও একটি ভ্রান্ত ধারণা আছে। আর তাহলো আমরা অনেকেই মনে করি, এই দাগগুলো চাঁদের কলঙ্ক। অথচ চাঁদ মহান আল্লাহর হুকুম মান্যকারী একটি সৃষ্টি।

সুতরাং চাঁদের কোনো কলঙ্ক থাকার কথা নয়। আর এটা বিজ্ঞানীরাও মেনে নিয়েছেন। তারা বলেন, চাঁদের পিঠ অত্যন্ত এবড়োথেবড়ো। সেখানে কালো কালো দাগ আছে। এই দাগগুলোই আমাদের কাছে চাঁদের কলঙ্ক মনে হয়।

আবার কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত বলে থাকেন, রাসুল (সা.) যে চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন, সেই খণ্ডিত অংশের মিলনস্থলের দাগগুলোই চাঁদের কলঙ্ক। যারা এমন মনে করেন তারা ভুলের মধ্যে আছেন। হ্যাঁ এটা সত্য যে, মহানবী (সা.)-এর হাতের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। আর তা হয়েছে আল্লাহতায়ালার হুকুমেই। ভাবুন তো, যে আল্লাহ চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করেছেন, সে আল্লাহ কি পূণরায় এই চাঁদকে নিখুতভাবে জুড়াতে পারেন না?

চাঁদ আমাদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ উপহার। তাছাড়া চাঁদই পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ, যা কিনা আমাদের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী। যদিও ১৫০ খ্রিস্টপূর্বাদ্বে, গ্রিক জ্যোতিবিজ্ঞানী হির্প্পাকাস (১২০-১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) ত্রিকোণমিতির প্রণালি দিয়ে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ৩৮৪, ৪০০ কিলোমিটার।

ভাবুন তো! যদি সৃষ্টি জগতে এই রূপালি চাঁদটা না থাকত তাহলে কেমন হতো রাতের পৃথিবী? কেমন হতো পৃথিবীতে বসবাসকারীদের অবস্থা? পৃথিবীর সবকিছু এখন যেভাবে চলছে, তা কি এই একই নিয়মে চলত? যদি না থাকত এই চাঁদ, তাহলে বদলে যেত আমাদের চারপাশের চিরাচরিত অনেক কিছুই। ২৪ ঘণ্টার দিন শেষ হয়ে যেত মাত্র ৬ ঘণ্টায়। সমুদ্রে থাকত না কোনো জোয়ারভাটা। জমিতে ফলত না সোনার ফসল। সুতরাং চাঁদকে শুধু আকাশে ঝুলিয়ে রাখা একটি গোলাকার আলোর বল হিসেবে ধারণা করলে তা হবে আমাদের জন্য চরম বোকামি। কেন না আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের আরো নানা সুবিধার্থেই চাঁদকে সৃষ্টি করেছেন। চাঁদের ¯িœগ্ধ কিরণ রাতের অন্ধকারে প্রাণিজগতের জন্য যেমন প্রদীপের মতো আলো বিতরণ করে, তেমনি রাতের পথযাত্রীকেও পথনির্দেশ করে। চাঁদের অন্যতম উপকারিতা হলো, এর মাধ্যমে মানুষ বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘তিনিই (আল্লাহ) সূর্যকে করেছেন তেজস্কর এবং চন্দ্রকে করেছেন কিরণদীপ্ত আর এর জন্য মঞ্জিল (তিথি) নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো।’ (সুরা ইউনুস : ৫)

চাঁদের নির্মল আলো মানুষকে ভাবুক করে তুলে। শান্ত নদীর প্রান্তজুড়ে শুভ্র কাশবনে জোছনার উছলে পড়া ঢেউ, কিংবা মেঠো পথের দু’ধারে ঘুমন্ত বৃক্ষপুঞ্জে চাঁদের রূপালি আলোয় যে চিত্র অঙ্কিত হয়, তাতে ব্যাকুল হয়ে উঠে কবিসত্ত্বা। চাঁদ আর চাঁদের আলো নিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেন অসংখ্যা কবিতা, গল্প-উপন্যাস। চাঁদকে নিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন-

‘বেবিলেন কোথা হারায়ে গিয়েছে/মিশর ‘অসুর’ কুয়াশার কালো।/চাঁদ জেগে আছে আজো অপলক/মেঘের পালকে ঢালিছে আলো।’

চাঁদের অঝোর জোছনায় সিক্ত হয়ে উঠে মুমিনের হৃদয়। হৃদয় মিনারে সুর বাজে প্রভুবন্দনার। মুমিনের আখিযুগল যতবার এই চাঁদের দিকে তাকায়, ততবারই মনে পড়ে প্রিয় নবীর সেই অমিয় বাণী। যে বানীতে স্বপ্ন আছে প্রভু দর্শনের। হজরত যাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক রাতে আমরা রাসুল (সা)-এর কাছে ছিলাম। হঠাৎ তিনি পূর্ণিমা রাতের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শোন, নিশ্চয় তোমরা তোমাদের প্রতিপালক। তেমিন স্পষ্ট দেখতে পাবে, যেমন স্পষ্ট এই চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ। তাকে দেখতে তোমরা কোনো ভিড়ের সম্মুখীন হবে না।’ (বোখারি শরিফ : ৫৫৪)।

চাঁদ আল্লাহতায়ালারই একটি সৃষ্টি তা বিনাবাক্যে মেনে নেয় আর এটাই মুমিনের পরিচায়ক। তা ছাড়া চাঁদ বলি আর সূর্য বলি, এসব কিছুই তো একদিন আলোহীনে পরিণত হবে। আল্লাহতায়ালা এ প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, ‘যেদিন সূর্যকে আলোহীন করা হবে।’ (সুরা তাকভীর : ০১)

এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কেয়ামতের সেই বিভীষিকার কথা বলেছেন। সেদিন সূর্যের আলোকে ম্লান করে দেয়া হবে। সুতরাং সৌরজগতের মূল কেন্দ্রবিন্দু সূর্যকেই যখন আলোহীন করে দেওয়া হবে, তখন তার গ্রহ-উপগ্রহগুলোও আলোহীন হয়ে যাবে। হাদিসে এসেছে, ‘কিয়ামতের দিন সূর্য ও চন্দ্র ষাঁড়ের আকৃতিতে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (বোখারি শরিফ : ৩২০০)।

তবে তা চন্দ্র-সূর্যকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে নয় বরং যারা তাদের পূজা করত তাদের ধিক্কার দানের উদ্দেশ্যে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও খতিব

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close