রেজাউল করিম খোকন

  ১৪ মে, ২০২২

নিবন্ধ

বিশ্বাস আর ভালোবাসার বন্ধনে

দিনের শুরুটা ঘর থেকেই। শেষটাও তাই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাল্টে যাচ্ছে জীবনযাপন প্রক্রিয়া। সকালের নাশতার টেবিল থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক কিংবা রূপচর্চা সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া খুব সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু এত পরিবর্তনের পরও পরিবারের বন্ধন আজও অটুট রয়ে গেছে। হয়তো সম্পর্কে টানাপড়েন বেড়েছে, যান্ত্রিকতার কারণে পারিবারিক বন্ধনে আগের সেই আন্তরিকতার প্রকাশ কমে যাচ্ছে দিন দিন। কিন্তু তার পরও পরিবারের বন্ধনের প্রভাব শত কর্মব্যস্ততায় কিংবা অবসর সময়ে মানুষের প্রতিটি মুহূর্তকে স্পর্শ করে।

জীবনটা খুব বড় নয়। কিন্তু যত দিন আমরা বাঁচি সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। মানুষের জীবনচক্রকে খুব সহজভাবে বলতে গেলে শুরুটা হয়, বাবা-মায়ের সংসার থেকে। তারপর শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে বয়ঃসন্ধি অতিক্রম করা। কলেজের রঙিন জীবন আর রোমান্সের নৈসর্গিক আঙিনা পেরিয়ে একসময় নিজেই সংসার বাধে বাবা-মায়ের আদরের সেই সন্তানটি। এরপর একসময় সেও সন্তানের বাবা-মা হয়। শুরু হয় আরেকটি প্রজন্মের পথচলা। প্রত্যেকটি মানুষই পারিবারিক বন্ধনের এই চিরন্তন আবহের অন্তর্ভুক্ত। একক কিংবা যৌথ, পরিবার যাই বলি না কেন, যেকোনো মানুষের প্রথম প্রেরণার উৎস তার পরিবার।

বাস্তবিক প্রয়োগে মানুষের জীবনকে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বিয়ের আগের এবং বিয়ে-পরবর্তী জীবন। সভ্যতার ক্রমবিকাশে মানুষ তার পারিপার্শ্বিক দায়িত্ববোধ থেকে অভ্যস্ত হয়েছে পরিবার প্রথায়। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ পরিবারবদ্ধ হয়ে থাকতে চেয়েছে। তবে যুগে যুগে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক কাঠামোয় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক কাঠামোয় পরিবর্তন এসেছে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী। সুনিয়ন্ত্রিত হয়েছে সবার দাম্পত্য জীবন। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সহযোগিতার এই চিরন্তন অবকাঠামোকে আমরা সহজভাবে বলি সংসার। বাস্তবতার আলোকে যথাযথ পরিকল্পনা হচ্ছে সুখের সংসারের ভিত্তি। সংসার সুখের হয় কেবল রমণীর গুণে নয়, বরং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দুজনের যৌথ প্রচেষ্টায়। এ প্রচেষ্টায় থাকে আবেগ- অনুভূতি, ভালোবাসা, মন্দ লাগা শেয়ারিং। দুজন দুজনাতে ভালোভাবে সুখে-দুঃখে পাশাপাশি থাকা। একজনের মতামতের প্রতি অন্যজন গুরুত্ব দেওয়া, দুজনের প্রতি দুজনের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, আস্থা, সহানুভূতি প্রভৃতি ভালোবাসায় যেমন গভীরতা আনে; তেমনি দাম্পত্য জীবনে জটিলতা কমায়।

সংসারে একই ছাদের নিচে বহু দিন বাস করেও অনেক স্বামী-স্ত্রী জানতে পারেন না তাদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া থাকা চাই। নয়তো সাধ ও সাধ্যের স্বপ্নের সাজানো সংসার কোনো দিনই হবে না। সুখী দাম্পত্য জীবনকে বিশ্লেষণ করা কঠিন। কারণ সুখটা আপেক্ষিক ব্যাপার। একেক জনের কাছে এর স্বরূপ একেক রকম। তার পরও বলতে হয়। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থা, বোঝাপড়াটা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসা যতই থাকুক না কেন দুজনের মধ্যে বোঝাপড়াটা না থাকলে সুখী দাম্পত্য জীবন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ফ্লেক্সিবল থাকারও দরকার আছে। এ ছাড়া দুজনের মধ্যে পরিবারকে গুরুত্ব দেওয়ার মানসিকতা থাকলে সুখী দাম্পত্য জীবন অসম্ভব কিছু নয়। দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝে দুজনের প্রতি দুজনের বিশ্বাস, আস্থা, সম্মান, শেয়ারিং ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। স্বামী-স্ত্রী কেউ কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতে পারবেন না। যার সঙ্গে সম্পর্ক তাকে অবশ্যই ভালো লাগতে হবে। এ ক্ষেত্রে লোক দেখানো মেকি কোনো কিছুর উপস্থিতি মেনে নেওয়া যায় না। দুজনের মধ্যে বিশ্বাস শক্ত হতে হবে। ‘কন্সিডারেট’ ও ‘সেক্রিফাইজিং মাইন্ডেড হতে হবে। এ দুটি শব্দ খুব শক্ত হলেও পরস্পরের প্রতি পছন্দের ক্ষেত্রে এ দুটি খুব সহজ-সাবলীল হয়ে যায়।

সময়কে সুন্দরভাবে ভাগ করে নিলে কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ততা পারিবারিক ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে না। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এ ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের চারপাশে যা কিছু আছে, তাই নিয়ে কমফোর্টেবল থাকলে দাম্পত্য সুখের পথে আর বাধাবিপত্তি, প্রতিকূলতা থাকে না। এই পৃথিবীতে একেকজন একেক কারণে সুখী হয়; যা সব সময় নির্দিষ্ট করে বলাও যায় না। দাম্পত্য সুখের প্রধান শর্ত হলো, পারফেক্ট লাইফ পার্টনার খুঁজে নেওয়া। জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই দুজনের মধ্যে মেন্টাল অ্যাডজাস্টমেন্টকেই গুরুত্ব দেন। দুজনের মধ্যে যথার্থ রেসপনসিবিলিটি থাকতে হবে। দুজনের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকলে অনেক সংকটময় মুহূর্তও সহজে অতিক্রম করে আসা যায়। বিয়ের জন্য একটু সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। যাকে ভালো লাগবে, যাকে ভালো বুঝতে পারা যায় তাকেই বেছে নেওয়া উচিত। তবে বিয়ের আগে থেকে পরিচয় থাকুক বা না থাকুক বিয়ে-পরবর্তী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটাই হবে সুখের সংসারের মূল্য চাবিকাঠি।

এই পৃথিবীতে কবে কার সঙ্গে বিয়ে হবে, এটা সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করে রেখেছেন। এখানে মনুষ্যত্ব বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ খুব। এটা থাকলে সব পাওয়া যায়। এটা না থাকলে সততা, উদারতা কিছুই তো টেকে না। সবার সামনে অথবা সমস্যা সৃষ্টি না করে, নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মানসিকতা ধরে রাখতে হবে। প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে ক্যারিয়ারের গুরুত্ব অনেক। দাম্পত্য জীবনে এ ক্ষেত্রে যদি বাধা আসে, তাহলে সেই ক্যারিয়ার বেশি দূর যেতে পারে না। দুজনের পারস্পরিক সহযোগিতায় ক্যারিয়ারে সাফল্য তো আসবেই। একজনের কাজে অন্যজনের হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই সুখকর কোনো ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যদি কর্মজীবী হন এবং একই অফিসে চাকরি করেন, সুবিধা-অসুবিধা থাকতেই পারে। একই অফিসে চাকরি করলে দুজনের কাজের এবং অবসর সময়টা একই হওয়ায় দুজন দুজনকে যেমন সময় দিতে পারেন ঠিকঠাকমতো। তেমনিভাবে অফিসের বাইরের পরিকল্পনাগুলো সুন্দরভাবে মিলে যায়। এখানে ভুল বোঝাবুঝির তেমন অবকাশ থাকে না। ভিন্ন পেশায় থাকলে একে অন্যের ব্যস্ততার গুরুত্বটা ঠিক বুঝতে পারে না। একই পেশায় থাকাতে তাদের অধিকাংশ সময় আলোচনার বিষয়বস্তুই থাকে প্রফেশন নিয়ে। একই প্রফেশনে থাকার সুবিধা হলো একে অপরের কাজে চাপ বোঝা যায়।

সংসারে খরচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যত সুন্দরভাবে এ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, সংসারও তত সুন্দরভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকবে। মাসের শেষে স্বামীর কিংবা স্বামী-স্ত্রী দুজনের বেতনের টাকা একত্র করে কোন কোন খাতে কত খরচ হবে, তার জন্য রাখতে হবে আলাদা আলাদা খাম। চাহিদা অনুযায়ী সেসব খামে বেতনের টাকাটা ভাগ হয়ে যায়। খরচাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সুকৌশলে। খরচটা আয়ের তুলনায় বেশি হলে তা মানসিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে। আয়ের মধ্যেই সংসারের যাবতীয় চাহিদাকে সীমাবদ্ধ রাখলেই কোনো রকম অস্বস্তি কিংবা মানসিক অস্থিরতা তাড়া করবে না।

দাম্পত্য জীবনের একটি বড় অংশজুড়ে আছে সন্তান। স্বামী-স্ত্রীর সারা দিনের কর্মক্লান্তির পর সন্তানের মুখটিই যেন প্রশান্তি বয়ে আনে। সন্তানের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব উপাদানের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বাবা-মায়ের। সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে আন্তরিক হতে হবে বাবা-মা উভয়কেই। সন্তান হওয়ার পর পরিকল্পিত পরিবারের গুরুত্ব বেড়ে যায়। সংসারে সন্তান আসার আগে স্বামী-স্ত্রীর মানসিক পরিবেশ তৈরি করা। ওর পড়াশোনা, বেড়ে ওঠার পরিকল্পনা এখন থেকেই করতে হবে। পরিকল্পিত পরিবারই শুধু নয়, যাপিত জীবনে পরিকল্পিত যেকোনো বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। অনেকেই বলেন, ডবল ও সিঙ্গেল লাইফের ব্যবধান আকাশ আর পাতাল। বিবাহিত জীবনটা উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ইচ্ছার ওপর। যদি এ ক্ষেত্রে কোনো গ্যাপ থাকে, তাহলে জীবনটা সে রকম বর্ণাঢ্য হয়ে উঠতে পারে না।

সংসারে এক ধরনের টানাপড়েন লেগে থাকে নিত্যদিন। জীবনে স্থিতিশীলতা এনে দেয় সংসার জীবন। দাম্পত্য জীবনে ঝগড়াঝাটি কিংবা মতের অমিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে হতেই পারে। তবে সময়ই আবার সব ঠিক করে দেয়। রিঅ্যাক্ট করলে সমস্যা বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। রিঅ্যাক্ট যতটা কম করা যায় ততই ভালো। দাম্পত্য সংকট সংসার জীবনের একটি অংশ, এটা মনে রাখতে হবে সবাইকে। এ নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। অনেক সংসারেই দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটান একে অন্যের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে। তবে তারা বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারেন না। পরে সবকিছুই ঠিক হয়ে যায়। এটা চিরন্তন একটি ছবি প্রতিটি সংসারে। একটা বিষয় ধরে বসে থাকাটা ঠিক নয়। একে অন্যের নিজস্ব সত্ত্বাটা নিয়ে মাথা না ঘামালে সংকট কম হয়। যেহেতু দুজন নর-নারী দুটি ভিন্ন সত্ত্বা নিয়ে বেড়ে ওঠে। তাই বিয়ের পর রাতারাতি একজন আরেকজনের মনের মতো হয়ে যাবে- এটা সম্ভব নয়। পারস্পরিক ম্যাচিং এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের জন্য সময় দেওয়া উচিত। যেকোনো সংকটে নার্ভাস না হয়ে, মাথা গরম না করে, দুজনের আলোচনার ভিত্তিতে মোকাবিলা করতে হবে। ভুল স্বীকার করলে ছোট হয়ে যেতে হয়, তেমন মানসিকতা থাকলে তা ঝেড়ে ফেলতে হবে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই। ভুল স্বীকার করলে সংসারে শান্তি-স্বস্তি এমনিতেই চলে আসে। দুজন দুজনকে একই সঙ্গে পয়েন্ট আউট করলে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। সংকট যেমন কারো কাম্য নয় আবার সংকট না থাকলেও সংসার জীবন একঘেয়ে ক্লান্তিকর মনে হয়। তবে দাম্পত্য সংকট বাড়তে দেওয়াটা ঠিক নয়। এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে সংসারে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে- এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে।

সভ্যতা ও প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে সব নর-নারীর মনমানসিকতা। জীবনের প্রয়োজনে আমরা সবাই নিজেদের আপডেট করে নিচ্ছি। যারা যোগ্য তারাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। সংসার জীবনে এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। স্ত্রীকে স্রেফ গতানুগতিক জীবনসঙ্গী না ভেবে মায়া-মমতায় ভরা, দায়িত্বে সজাগ, গুণেমানে আপসহীন, তাকে ছাড়া চলে না সংসারে একটি দিন, সত্যি সে প্রতিদিন তুলনাহীন- ভাবতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close