মো. আরাফাত রহমান

  ১১ মে, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

প্লাস্টিক দূষণ এক মারাত্মক হুমকি

পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টিকারী একটি উপকরণের নাম প্লাস্টিকদূষণ। আকারের ওপর ভিত্তি করে, মাইক্রো, মেসো অথবা ম্যাক্রো বর্জ্য এই তিন ভাগে প্লাস্টিকদূষণকে শ্রেণিকরণ করা হয়। নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার প্লাস্টিকদূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশির ভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না। এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যরে আকার নেয়। মানুষের অসচেতনতাই প্লাস্টিকদূষণের প্রধান কারণ।

প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ যা পরিবেশে পচতে অথবা কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে প্রচুর সময় লাগে। তাই একে অপচ্য পদার্থ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তাই প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। সাধারণত উদ্ভিদকূল, জলজ প্রাণী, দ্বীপ অঞ্চলের প্রাণীরা প্লাস্টিক বর্জ্যরে জন্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য ওইসব প্রাণীর বাসস্থান, খাদ্য সংগ্রহের স্থান ও উদ্ভিদের খাদ্য গ্রহণের পথে বাধার সৃষ্টি করে। শুধু উদ্ভিদ বা জলজ প্রাণী নয়, মানুষ প্লাস্টিকদূষণের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণের জন্য প্লাস্টিকদূষণ পরোক্ষভাবে দায়ী। শুধু আমেরিকাতে প্রতি বছর পাঁচ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

সাধারণত প্লাস্টিক দূষণের জন্য দুই ধরনের প্লাস্টিক দায়ী- মাইক্রো প্লাস্টিক বা ক্ষুদ্র প্লাস্টিক যা সাধারণত মেগা বা বৃহৎ হিসেবে পরিগণিত এবং ম্যাক্রো প্লাস্টিক। প্লাস্টিক বর্জ্য প্রাথমিক বা মাধ্যমিক হিসেবেও শ্রেণিকরণ করা হয়ে থাকে। প্রাথমিক প্লাস্টিক সংগ্রহের সময় তাদের মূল গাঠনিক অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বোতলের ঢাকনা, সিগারেট বাট এবং মাইক্রো বর্জ্য। যেসব প্লাস্টিক বর্জ্যরে আকার দুই ক্রস থেকে পাঁচ মিমির মধ্যে, সেসব প্লাস্টিক বর্জ্যকে মাইক্রো বর্জ্য বলা হয়। মেসো ও ম্যাক্রো বর্জ্যকে ভাঙন ও পেষণের মাধ্যমে মাইক্রো বর্জ্যে পরিণত করা যায়। মাইক্রো বর্জ্য সাধারণত নারডল নামে পরিচিত। নারডল দিয়ে নতুন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করা হয়ে থাকে। কিন্তু ক্ষুদ্র আকারের কারণে এগুলো দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে পারে।

মাইক্রো বর্জ্যরে ক্ষুদ্র আকারের কারণে ফিল্টার ফিডিং জীব এগুলো গ্রহণ করে। ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড থম্পসন গবেষণার মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এন্টার্কটিকা অঞ্চলের সাগরের পানিতে প্রচুর পরিমাণে মাইক্রো বর্জ্য খুঁজে পান। থম্পসন ও তার সহযোগীরা ওই অঞ্চলের পানিতে গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ভাঙা অংশ খুঁজে পান, যার কিছু মানুষের চুলের থেকেও ক্ষুদ্র। মাইক্রো বর্জ্য প্রায়ই সমুদ্রের পানির মধ্যে পাওয়া যায় যা সামুদ্রিক জীবের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপত্তির স্থান থেকে বিভিন্ন উপায়ে ভিন্ন ভিন্ন আকারে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। সমুদ্র স্রোত, বাতাসের অসম গতি, ভৌগোলিক বৈচিত্রতার কারণে প্লাস্টিক বর্জ্য বিভিন্ন উপায়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

যেহেতু প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ, তাই সৃষ্টির পর পুনঃচক্রায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটি পরিবেশে অবস্থান করে। বিভিন্ন উপায়ে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের ভারসম্যকে নষ্ট করছে। ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূপৃষ্ঠীয় পানির সঙ্গে মিশে যায়। অতঃপর ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠীয় পানি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তা আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে। কারণ এটির মাটিতে পচতে সময় লাগে ৪০০ বছর। আর এভাবেই পানি গ্রহণের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। মাটিতে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব বাস করে যা প্লাস্টিক অণুর ভাঙনে সাহায্য করে। এসব অণুজীবের মধ্য সিউডোমোনাস, নাইলন খাদক ব্যাকটেরিয়া, ফ্লাভো ব্যাকটেরিয়া অন্যতম। এসব ব্যাকটেরিয়া ‘নাইলোনেজ’ এনজাইম ক্ষরণের মাধ্যমে নাইলন অণুকে ভেঙে ফেলে।

জীবাণুবিয়োজ্য প্লাস্টিক ভাঙনের মাধ্যমে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। মিথেন এক প্রকার গ্রিন হাউস গ্যাস। এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। ২০১২ সালে গবেষণার মাধ্যেমে জানানো হয় যে, সমগ্র বিশ্বের সমুদ্রে আনুমানিক ১৬৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আছে। নারডল নামক এক প্রকার শিল্পজাত প্লাস্টিক পণ্য বা কার্গো শিপ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। প্রচুর পরিমাণে নারডল সমুদ্রের পানিতে পতিত হয়। বছরের পর বছর এই প্লাস্টিক পদার্থের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এর ফলে প্লাস্টিক থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেমন- বায়োস ফেনল, পলিস্টিরিন ইত্যাদি পরিস্রুত হয়।

এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, সমুদ্রের পানিতে পাঁচ ট্রিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক ভেসে থাকে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ তারা আছে, সমুদ্রে প্লাস্টিক তার থেকেও বেশি। ১৪ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক প্রতি বছর সমুদ্রে জমা হচ্ছে। প্লাস্টিকদূষণ সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য একক সর্বাধিক হুমকির মতো। বেশকিছু সামুদ্রিক প্রজাতি যেমন- সামুদ্রিক কচ্ছপের পাকস্থলীতে বিজ্ঞানীরা প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য পেয়েছেন। যখনই এমনটা ঘটে, তখন ওইসব প্রাণী ক্ষুধায় ভোগে কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য তাদের পরিপাকতন্ত্রকে বন্ধ করে দেয়। সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যু প্লাস্টিক দূষণের কারণে ঘটছে। সামুদ্রিক কচ্ছপ সাধারণত জেলিফিশ, সামুদ্রিক কীট খেয়ে জীবন ধারণ করে। জেলিফিশের আকার ও আকৃতি প্লাস্টিক ব্যাগের মতো হওয়ায় কচ্ছপ ভুল করে প্লাস্টিক ব্যাগ ভক্ষণ করে। এতে তাদের খাদ্য নালিকা বন্ধ হয়ে যায় এবং খাদ্য গ্রহণ করতে অক্ষম হওয়ায় ধীরে ধীরে মারা যায়।

এর চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামুদ্রিক তিমি। সামুদ্রিক তিমির পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও সামুদ্রিক ছোট মাছের পাকস্থলীতে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। তাই প্লাস্টিকদূষণ সামুদ্রিক মৎস্য প্রজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। প্লাস্টিকদূষণের প্রভাব শুধু সামুদ্রিক মাছের ওপর নয় সামুদ্রিক পাখির ওপরও রয়েছে। কারণ সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক ও মাছের মধ্য তুলনা না করতে পারায় পাখিরা প্লাস্টিক গ্রহণ করে। প্লাস্টিক পদার্থ থেকে সাধারণত বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়। এই বিষাক্ত রাসায়নিক দেহের বিভিন্ন টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পাখিরা যখন প্লাস্টিক পদার্থ গ্রহণ করে তখন তাদের পেটেও বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়। এর জন্য তাদের দেহের টিস্যু ধ্বংস হয়, তাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ধীরে ধীরে পাখির মৃত্যু হয়।

আরেক রকমের ডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক দেখা যায় যা বায়োপলিমার দ্বারা প্রস্তুত নয়, কারণ এগুলো তেল ভিত্তিক এবং অন্যান্য চিরাচরিত প্লাস্টিকের মতোই আচরণ করে। এই প্লাস্টিকগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বিভিন্ন এডিটিভের সহায়তায় এগুলোর সহজে ক্ষয় হয়। সূর্যের অতিবেগুণি রশ্মি বা অন্যান্য ভৌত নিয়ামকের সহায়তায় এই এডিটিভগুলো এগুলোর দ্রুত ক্ষয়ে সহায়তা করে। যদিও বায়োডিগ্রেডেবল ও ডিগ্রেডেবল প্লাস্টিকগুলো প্লাস্টিকদূষণ রোধে সহায়তা করে, এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। একটি সমস্যা হচ্ছে এরা প্রাকৃতিক পরিবেশে খুব একটা কার্যকরীভাবে ক্ষয় হয় না। তেল ভিত্তিক প্লাস্টিকগুলো একটি ক্ষুদ্রতর অংশে বিভাজিত হয়, কিন্তু এরপরে তারা আর ক্ষয়ীভূত হয় না।

ব্যবহৃত প্লাস্টিক মেডিকেল সামগ্রী এর মধ্যে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ল্যান্ডফিলের বদলে চুল্লিতে ভস্মীভূত করা হয় যাতে রোগের ব্যাপ্তি কমে আসে। এর ফলে মেডিকেল সামগ্রী থেকে আসা প্লাস্টিক বর্জের পরিমাণ প্রচুর পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। যদি প্লাস্টিক বর্জ্যকে ভস্মীকরণের মাধ্যমে সঠিকভাবে মীমাংসা না করা হতো তাহলে এখান থেকে যে ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হয়েছে তা বাতাসে গ্যাস হিসেবে বা পানি ও বাতাসে ছাই হিসেবে ছড়িয়ে যেতে পারত। অবশ্য অনেক গবেষণাতেই ইনসিনারেশনের ফলে যে বায়বীয় পদার্থ নির্গত হয় সেই ব্যাপারে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করা হয়েছে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি প্রায়ই নেতিবাচক দিক না ধরা পড়া অবধি নতুন রাসায়নিক দ্রব্যের নিরাপত্তা নিয়ে মূল্যায়ন করে না। একবার সেই রাসায়নিক দ্রব্যকে বিষাক্ত হিসেবে সন্দেহ করা হলে, মানব আদর্শ ডোজ এর প্রেক্ষিতে একে গবেষণা করা হয়। এই মানব আদর্শ ডোজ হচ্ছে মানুষের জন্য সবচেয়ে কম ক্ষতিকর প্রভাবের মাত্রা। এই গবেষণার সময় উচ্চ ডোজকে পরীক্ষা করে দেখা হয় যদি এটা স্বাস্থ্যে কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আর যদি তা না হয়, তাহলে কম ডোজকে এমনিতেই নিরাপদ হিসেবে ধরা হয়।

প্লাস্টিকে পাওয়া কিছু কেমিক্যাল, যেমন বিপিএ নিম্নমাত্রার ডোজে উপস্থিত থাকলেও তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্ষতি করতে পারে। তবু এরকম জটিল মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সত্ত্বেও প্লাস্টিকদূষণ ও এর কারণে হওয়া ক্ষতি কমানোর জন্য বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। সরকারিভাবে বিভিন্ন নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে যাতে নির্দিষ্ট কিছু প্লাস্টিক সামগ্রীতে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যকে ব্যবহার করা না হয়। বিভিন্ন দেশে বাচ্চাদের বোতল এবং কাপে বিপিএ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

লেখক : সহকারী কর্মকর্তা

ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস

বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close