আকিজ মাহমুদ
পর্যালোচনা
ইউক্রেন কি আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে
ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে। সীমান্তে রাশিয়ার এই বাড়তি সেনা উপস্থিতিতে স্বভাবতই শঙ্কিত ইউক্রেন। সামরিক সক্ষমতা বিবেচনায় রাশিয়ার ধারেকাছেও না থাকা দেশটি তাই সচকিত হয়ে তাকিয়ে আছে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে পশ্চিমারাও পাশে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেনের। কিন্তু তাতেও যেন কিছুতেই মিলছে না সমীকরণ। রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতি ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। যুদ্ধ এড়াতে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বারবার দুটি দেশকে আলোচনার টেবিলে বসার অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু রাশিয়ার উচ্চাশায় তা পরিণতি পাচ্ছে না কিছুতেই।
উদ্ভূত এই ইউক্রেন পরিস্থিতির দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না পশ্চিমারা। ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার কথা বলে জল ঘোলা তারাই করেছে। তবে ইউক্রেন পরিস্থিতি যতই অবনতি হোক না কেন, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের পথটা পুতিনের জন্যও খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হয় না। কারণ মার্কিন ও তার পশ্চিমা মিত্ররা আন্তর্জাতিক মহলে কোনোভাবেই রাশিয়াকে দৃঢ় পায়ে দাঁড়াতে দিতে চায় না। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরও সে নীতি থেকে সরে আসেনি তারা। ফলে রাশিয়া যে ক্রিমিয়ার আদলে ইউক্রেনকেও একীভূতকরণের পথে হাঁটছে, তা গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করছে পশ্চিমা দেশগুলো। কেবল পর্যবেক্ষণ নয়, রাশিয়াকে সতর্ক করে একের পর এক হুমকিও শোনাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। একই সঙ্গে ২০১৪ সালের পর থেকে ইউক্রেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক যে সহযোগিতা পেয়ে আসছিল এবং পরবর্তীতে যা ট্রাম্প প্রশাসন উঠিয়ে নেয়, বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন সে সহযোগিতা আবার নতুন করে চালু করার পক্ষে কাজ করছেন।
কৃষ্ণসাগর উপকূলের সমীকরণটি আরো জটিল হয়ে উঠেছে তুরস্কের অবস্থান নিয়ে। তুরস্ক খুব স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। ১৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক সুসম্পর্কের পাশাপাশি সমরাস্ত্র দিয়েও রাশিয়ার বিপক্ষে ইউক্রেনকে লেলিয়ে দিচ্ছে তুর্কিরা। এতে যে তুরস্কও প্রতিবেশী দেশের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থনের কথা ভেবেই ঝুঁকিপূর্ণ এই রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করছে তুরস্ক।
তবে এসব হুমকি খুব বেশি আমলে নিচ্ছে না রাশিয়া, কেননা সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ নিয়ে পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে শত অভিযোগ এলেও সেনা প্রত্যাহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। প্রসিডেন্ট পুতিন উল্টো পশ্চিমাদের এই বলে হুশিয়ার করেছেন যে, তারা যদি ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে তা রাশিয়া কোনোভাবেই বরদাশত করবে না। পুতিন অভিযোগ করছেন, মার্কিন জোট ইউক্রেনকে সামরিক ও অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। তবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে যা কিছুই বলা হোক না কেন, ইউক্রেন পরিস্থিতি আরো অবনতির দায় রাশিয়া কাঁধে তুলে নিলে পুরো ইউরোপ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রক্তাক্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। যে সংঘাত শুরু হলে রাশিয়ার লাভের চাইতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। কেননা, রাশিয়া কোনোভাবে এই যুদ্ধে জড়ালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হবে, একই সঙ্গে সাধারণ ইউক্রেনিয়ানদের কাছেও নৈতিক স্থুলকায় উপস্থাপিত হবে দেশটি। এতে করে যে লক্ষ্য নিয়ে পুতিন আগামীর পথে দৃষ্টি রাখছেন, সে পথ আরো রূঢ় হতে পারে। রাশিয়ার সামনে যেহেতু এত প্রতিবন্ধকতা; সেহেতু প্রশ্ন জাগে, পুতিন কেন পিছু হটছেন না, কেন নিজেদের অবস্থান এখনো জোরালো রেখেছেন সীমান্তে?
১৯৯১ সাল পর্যন্ত ইউক্রেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। সোভিয়েত পতনের পর নানাভাবে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার মিথস্ক্রিয়া লক্ষ করা যায়। রাশিয়ার সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতিগত মিল থাকা দেশটির ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আগ্রহ পুতিনকে অসন্তুষ্ট করে তুলেছে। ফলে ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার দাবি পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে তুলেছে। তাছাড়া ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল প্রক্রিয়া নিয়ে যে সমালোচনা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে, তাতে শামিল হয়েছিল ইউক্রেনের নেতৃত্বও। স্বভাবত রাশিয়ার এই আগ্রাসী মনোভাব থেকে সুরক্ষার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ে ইউক্রেন। এতে করে ন্যাটোর সম্প্রসারণের পথটাও উন্মুক্ত হয় মার্কিন জোটের কাছে। আর এই পরিকল্পনা পশ্চিমা জোট বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলে, তা হবে এক প্রকার রাশিয়ার কাঁধে বিরোধীদের নিঃশ্বাস ফেলার মতো। যা একবিংশ শতাব্দীর দুর্বল রাশিয়ার বুকে পেরেকের নির্মম আঘাতেরই সমতুল্য। ফলে ন্যাটোর সম্প্রসারণ রুখতে প্রয়োজনে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাতেও পেছপা হবে না রাশিয়া।
২০১৪ সালের পরে প্রায় ৮ থেকে ১০ বার যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয় রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে, যা চুক্তি অনুযায়ী স্থায়ী হয়নি। বারবার শর্ত ভাঙার জন্য জন্য ইউক্রেন তার পূর্বাঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দায়ী করে এবং অভিযোগ আছে, রাশিয়া পূর্বাঞ্চলের এসব বিদ্রোহীর নাগরিকত্ব দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের নাগরিক বলে দাবি করতে পারে। এতে করে নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর দমনপীড়নের অভিযোগ তুলে ইউক্রেন আক্রমণের নৈতিক অবস্থান পোক্ত করার পাঁয়তারা করছে তারা।
রাশিয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে চীনও। কেননা রাশিয়া ও চীনকে একঘরে করতে মার্কিন ও তার পশ্চিমা মিত্ররা যেভাবে আটঘাট বেঁধে নেমেছে, তা ক্রমেই দুটি দেশকে এক সুতোয় বাঁধছে। পশ্চিমাদের এই ক্রমবর্ধমান রাশিয়াবিরোধিতা তাই দিন দিন যথেষ্টই হুমকির মুখে পড়ছে। কারণ দুটি দেশ একত্র হলে, তা পুরো পৃথিবীকেই নিজেদের অক্ষে আনার সক্ষমতা রাখে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও রাশিয়া পরস্পর স্বার্থে এক পথে হাঁটার যে সংকল্প নিচ্ছে, তা মোটামুটিভাবে এখনো নির্ভরশীলতার জায়গায় উপনীত হয়নি। কেননা, চীনের উচ্চাকাক্সক্ষা রাশিয়ার জন্যও অস্বস্তির। এই সুযোগটিই কাজে লাগাতে পারে পশ্চিমারা, এমনকি এতে যদি রাশিয়াকে কিছু ছাড় দিয়েও করতে হয়, সেক্ষেত্রেও পশ্চিমাদের খুব বেশি ক্ষতি হবে না।
মূলত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চাপে থাকা রাশিয়া এসব সমীকরণকে কাজে লাগিয়েই নিজেদের অবস্থান বজায় রাখছে। ২৪০০ কিলোমিটারেও বেশি সীমান্তসীমা নিয়ে রাশিয়ার পাশে অবস্থান করা ইউক্রেনের পশ্চিমামুখী নীতি মোটেই দেশটির জন্য স্বস্তির কারণ হতে পারে না। অতএব ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার বিপক্ষে কিংবা একীভূকরণে পুতিন যে প্রক্রিয়া নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের ন্যায় আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। আর এমনটি যদি বাস্তবে পরিণত হয়, তা পুরো কৃষ্ণসাগরকে রক্তিম সাগরে পরিণত করবে। পুরো ইউরোপকে রক্তক্ষয়ী আরেকটি যুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে সমীকরণের জট খুলে বিশ্ব মোড়লেরা কী সিদ্ধান্ত নেয়- সেটিই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"