আহমেদ আমিনুল ইসলাম

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২২

প্রত্যাশা

সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে

স্বাগত খ্রিস্টীয় নতুন বছর ২০২২। ২০২০ সালের মতো সদ্য বিদায়ি ২০২১ সালটিও বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯সহ সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যার আবর্তে আমরা জড়িয়ে ছিলাম। বিচিত্র সমস্যা, দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা এবং অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আমরা আমাদের জীবন থেকে একটি বছর পেছনে ফেলে আরেকটি বছরের গাণিতিক সংখ্যার মধ্যে প্রবেশ করেছি। নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্যেই আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। উদযাপন করেছি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বর্ষ। ‘মুজিববর্ষ’ নামের প্রেরণা সঞ্চারি ও উদ্দীপনামূলক দুটি বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়েছে নানা কর্মসূচি। বাস্তবায়িত হয়েছে নানা রকমের প্রকল্প। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে বহুসংখ্যক গৃহহীনের ঘর এবং ভূমিহীনের ভূমি। পরিকল্পিত উন্নয়ন ধারার বাইরে শেখ হাসিনার সৃজনশীল উদ্যোগে আসপিয়ার মতো ভূমিহীনদের ভূমিসহ কর্মসংস্থানও নিশ্চিত হয়েছে অনেকের। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মানুষের মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি সার্বিকভাবে ব্যক্তিজীবনেও লেগেছে ‘উন্নয়নের স্পর্শ’। উন্নত জীবনের লক্ষ্যে এই স্পর্শের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। ‘উন্নয়নের স্পর্শে’র এই প্রেরণাটুকুই সাধারণ মানুষকে উন্নত জীবনের দিকে ধাবিত হতে সহায়তা করবে। মুজিববর্ষে যে উন্নয়নশীল দেশ অর্জনে সক্ষম হয়েছি ২০৪১ সালের মধ্যে তা শেখ হাসিনার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার ‘উন্নত ও সমৃদ্ধ’ রাষ্ট্রে পরিণত হবে- এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। মূলত বাংলাদেশ এখন শেখ হাসিনার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রসরমান। কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতায় এই অগ্রযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়, দেশপ্রেমিক প্রত্যেকটি নাগরিকের সেই কর্তব্য-পথই রাষ্ট্রের স্বার্থ ও কল্যাণে গ্রহণ করা শ্রেয়।

নতুন বছরকে বরণের আগ্রহ স্বভাবতই সবার মধ্যে বিরাজ করে। সবার মধ্যে বিরাজ করে নতুন বছরে লাভবান হওয়ার, সফল হওয়ার, সুখী ও সমৃদ্ধ হওয়ার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। ব্যক্তিগত জীবন অতিক্রম করে এ আকাক্সক্ষা সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রীয় কল্যাণের নিমিত্তেও সচেতন বা অবচেতন মনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগতভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এও আমরা প্রত্যাশা করি যে, আমাদের রাষ্ট্রটিও কল্যাণকর একটি রাষ্ট্রে পরিণত হোক, একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হোক। ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা বা সাফল্য লাভের পশ্চাতে যেমন ব্যক্তির নিরন্তর সক্রিয় প্রয়াস জরুরি; তেমনি রাষ্ট্রের সাফল্যের পশ্চাতে সামষ্টিক মানুষের উদ্দীপনামূলক সক্রিয় প্রয়াস জরুরি। সেই সঙ্গে জরুরি একটি পরিকল্পিত রূপরেখা। অগ্রযাত্রার পরিকল্পিত রূপরেখাটিও নির্দিষ্ট আছে। আমরা দেখেছি সেই রূপরেখাটি সামনে রেখেই শেখ হাসিনা তার সুদূরপ্রসারী কর্মযজ্ঞে নিবেদিত রয়েছেন। আমরা তার সেই অগ্রযাত্রার সহযাত্রী হতে পেরে গর্বিত এবং আনন্দিত।

আমরা বরাবরই বলে আসছি শেখ হাসিনার ‘উন্নত ও সমৃদ্ধ’ বাংলাদেশের এই স্বপ্ন আওয়ামী লীগ এবং সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের সব কর্মী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের গভীরভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। সবার মধ্যে শেখ হাসিনার এই স্বপ্নটি প্রণোদিত করতে পারলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আমাদের অভিযাত্রা নির্দিষ্ট সময়েই সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু সবার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই স্বপ্নটি স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রতিফলিত নয় বলেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে মাঝেমধ্যে দুর্নীতির ব্যাপকতা দেখি। যা দেশের সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কত রকমের প্রতিবন্ধকতা থাকে তা বলে শেষ করার নয়। কিন্তু এরই মধ্যে আবার দলীয় কিংবা সরকার সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা, অবহেলা ও দুর্নীতির কালো থাবা থাকলে ব্যক্তি-বিশেষের আর্থিক উন্নতি ঘটলেও সামষ্টিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয় অগ্রযাত্রার কাক্সিক্ষত সাফল্য ঘরে তোলা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের প্রকল্পে দুর্নীতিরও বৈচিত্র্যপূর্ণ ধরন দেখা যায়। দায়িত্বশীলদের এরূপ দুর্নীতিগ্রস্ততা আমাদের ভাবিত করে। কিছু কিছু নেতা ও মন্ত্রীর আচার-আচরণও সাধারণকে সংক্ষুব্ধ করে। ২০৪১ সালের উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কল্পিত চিত্রটি তখন এসব দুর্নীতিবাজের কারণে অস্পষ্ট হয়ে পড়ে! বারবারই আমরা বলার চেষ্টা করি, কেবলমাত্র ‘দুর্নীতি’ এবং ‘অর্থপাচার’ নামক ব্যাধির যদি অর্ধেকও উপশম করা যেত তবে আমাদের উন্নয়ন আরো দৃশ্যমান হতো। আমাদের সাফল্য, সক্ষমতা এবং জীবনমানের উন্নতি আরো বহুল পরিমাণে উপভোগ্য হতো। মধ্যবিত্ত থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটত। শ্রেণিভেদে নানামুখী বৈষম্যও হ্রাস পেত। দুর্ভাগ্য যে, সর্বত্র আমাদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে না।

তবুও নতুন বছরে আমরা আশার বীজ বপন করি। কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য আমাদের কম নেই! বিভিন্ন ধরনের ‘মেগা প্রকল্প’-এর বাস্তবায়ন আমাদের সক্ষমতাকে দৃঢ়তর করে। এসব প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন থেকে আমরা আরো বড় ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের স্পর্ধায় স্পন্দিতও হয়ে উঠি। বিদায়ী বছরে স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স ৫০ বছর। অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক মুক্তিসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আদর্শ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল চারটি মূলনীতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জাতীয় জীবন থেকে আদর্শিক সেসব নীতি বিসর্জিত হয়েছিল। উপরন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৫০ বছর বয়সি রাষ্ট্রের ২১টি বছর কেটেছে স্বৈরশাসন কিংবা ছদ্ম স্বৈরশাসনের অধীন। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে তারা বিপথগামী করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে এবং পরাজিত শক্তির সমর্থনে শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে উগ্র মৌলবাদীদেরও ক্ষমতার অংশীদার করার নজির স্থাপিত হয় ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম এই রাষ্ট্রটিতে! দিকে দিকে আজ সাম্প্রদায়িক শক্তির যে হুঙ্কার ধ্বনিত হয় তার পেছনে ১৯৭৫ পরবর্তী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা শক্তিটির দায়ই বেশি। তাদেরই আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে মৌলবাদী গোষ্ঠীটি নানাভাবে আজও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেশের ভেতর বৈষম্য ও ভেদাভেদ সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। ক্ষমতার লোভে ধর্মনিরপেক্ষ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকে স্বৈরশাসকরা পরাজিত শক্তির সমর্থনে ধাপে ধাপে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার সব চেষ্টাই সূক্ষ্ম কৌশলে সম্পন্ন করেছে! তবু এরই মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ভঙ্গুর-প্রায় এই দেশটিকে একটি সুসংহত রাষ্ট্রে পরিণত করার ব্রত গ্রহণ করেছেন। বিগত প্রায় ১২ বছরের দায়িত্বে থাকাকালীন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে তিনি একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে উন্নীত করেছেন। ৫০ বছর বয়সি রাষ্ট্রটি কেবল মাত্র শেখ হাসিনার হাতে ছিল বলে আজ আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত। কোভিড মহামারির সংক্রমণ-ছোবলে সমগ্র বিশ্বের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির যখন টালমাটাল অবস্থা তখনো বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে তার অবস্থান অটুট রাখতে সক্ষম। অর্থনীতির চাকা সচল রেখেও কোভিড নিয়ন্ত্রণে শেখ হাসিনার সরকার নানা রকমের কৌশলপত্র গ্রহণ করেছিল। বিগত বছরেও সরকারকে কয়েক দফা কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়েছিল। জীবন ও জীবিকা বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে অবস্থা বুঝে ধাপে ধাপে সরকার ও শিল্পোদ্যোক্তরা অফিস-আদালত, কল-কারখানা এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচল রাখার কৌশল গ্রহণ করেছিল। সমগ্র বিশ্বেই মানুষের স্বাভাবিক জীবন, অর্থনীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় করোনার নেতিবাচক প্রভাবে জর্জরিত করেছে। বাংলাদেশ সে প্রভাবমুক্ত না হলেও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও পার্শ¦বর্তী রাষ্ট্রগুলোর কাছে বাংলাদেশের সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ষে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভ এক বিরল অর্জন। এই অর্জনের পেছনে ছিল সরকারের সুপরিকল্পিত পন্থায় পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন সক্ষমতা। সুষ্ঠু পরিকল্পনাসহ এই গতিতে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালে ‘উন্নত ও সমৃদ্ধ’ বাংলাদেশ কেবল আজ স্বপ্ন মাত্র থাকবে না, তা হবে আমাদের উত্তর প্রজন্মের কাছে প্রকৃত বাস্তবতা!

গভীর পর্যবেক্ষণে আমরা একটি বিষয় দেখেছি যে, করোনাকালে বিশ্বে সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং অপরাধপ্রবণতা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা আমাদের কাছে মাত্রাহীন বলেই বোধ হয়েছে। সামাজিক অপরাধপ্রবণতা রোধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা যেমন জরুরি; তেমনি জরুরি বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা। বিচারকার্য দ্রুত দৃশ্যমান না হলে জনজীবনে তার প্রভাব দৃষ্ট হয় না। তবে এ কথাও স্বীকার্য যে, কেবল আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই সমাজের অপরাধ প্রবণতা হ্রাস করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক স্থিতিশীলতা। সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার বিকল্প নেই। নতুন প্রজন্মকে সংস্কৃতি সচেতনভাবে গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের সব অর্জনই মøান হয়ে যাবে। সুস্থ, সমর্থ এবং সংস্কৃতিবান নতুন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। নতুন বছরে নতুন প্রতিজ্ঞায় উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের অভিমুখে আমরা শুরু করি আমাদের অভিযাত্রা।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close