ফরিদা নাসরীন

  ২১ নভেম্বর, ২০২১

দৃষ্টিপাত

এলডিসি থেকে উত্তরণে বিদেশি ঋণের প্রভাব

করোনা মহামারি বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন থেকে বেরিয়ে আসাটা দুই বছর পিছিয়ে দিয়েছে। ফলে ২০২৪-এর স্থলে ২০২৬-এ এলডিসি থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করবে বলে আশা করা যায়।

জাতীসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে জাতিসংঘের সহায়তা, শান্তিরক্ষা কার্যক্রম, জাতিসংঘের আওতাধীন ফ্রিনজ ব্যানিফিট যেমন- ভ্রমন ভাতা, ফেলোশিপ, বিভিন্ন বৃত্তি ওইসিডির আওতায় উন্নয়ন সহায়তাসহ কারিগরি সহায়তা পেয়ে আসছে। এলডিসি দেশ হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ বাজেটের শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ চাঁদা প্রদান করে এসেছে, ২০১৫-এরপর নিম্নমধ্যম ও মধ্যম আয়ের দেশের যোগ্যতা অর্জন করায় ওই চাঁদার হার বেড়ে শূন্য দশমিক শূন্য ৬৯ শতাংশে দাঁড়ায়। উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর চাঁদার হার প্রায় ৫ থেকে ৬ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে অনুমিত হয়। এ ছাড়া জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা যেমন- UNDP, IFAD, UNVO, UNEP, UNICEF, UNFPA, UNODC, UN ইত্যাদি সংস্থায়ও চাঁদা দিতে হয়। সাভাবিক নিয়মে উক্ত চাঁদার হার অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাবে।

জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা কার্যক্রমের জন্য এলডিসি সুবিধা হিসেবে যে ৯০ শতাংশ হ্রাস অবকাশ পেয়েছে তা গ্র্যাজুয়েশন মর্যাদা পাওয়ার পর বেড়ে শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য ১ শতাংশ বেড়েছে এবং গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর তা আরো বেড়ে হ্রাসের হার ৮০ শতাংশে দাঁড়াবে। তাতে চাঁদার হার শূন্য দশমিক শূন্য ১৩৮ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের পর চাঁদা ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে জাতিসংঘ ছাড়াও অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে যে বৃত্তি সুবিধা পেয়ে আসছে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সঙ্গে সেসব সুবিধা হ্রাসের খুব একটা সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয় না।

কেননা ওডিএ সহায়তা বিশেষ করে কারিগরি ওডিএ দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক দেশগুলো উন্নয়ন সূচকের মাত্রা ও গড় জাতীয় আয়ের পরিমাণের ভিত্তিতে চাঁদা নির্ধারণ করে, এলডিসি হতে উত্তরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়। অপরদিকে ঋণের অঙ্গীকারের তথ্য হতে দেখা যায়, ২০১০-পরবর্তী সময়ে গড়ে প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অঙ্গীকার হয়েছে এবং ক্রমাগত হারে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় প্রতি বছর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়ে নতুন রেকর্ড তৈরি করে যাচ্ছে। যা প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অগ্রগতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের ইঙ্গিত বহন করে। এ ছাড়া ২০১৩ হতে জাতীয় মাথাপিছু গড় আয়ে ৯৫০ ইউএস ডলার হতে ২ হাজার ১০০ মার্কিন ডলারের ওপরে ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি আরো একটি উন্নয়নের মাইলফলক।

২০১৫-১৮-পরবর্তী চিত্র বলে দেয় ২০১৬ সালের পর বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি ও ব্যয়ন যথাক্রমে প্রায় ১ দশমিক ৫০ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়েছে যা স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ ঝুঁকিসীমা ৪০-এর অনুকূলে ১১-১৫ অবস্থানে রয়েছে যা ঋণ ধারণক্ষমতার অনেক শক্তিশালী অবস্থার ইঙ্গিত বহন করে। নিম্নমধ্যম ও মধ্যম আয়ের স্তরে উত্তীর্ণের পর বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি এবং ব্যত্যয়হীনভাবে ঋণ পরিশোধ চিত্র হতে প্রতিয়মান হয় এলডিসি উত্তোরণের পর ঋণ আহরণ বাড়বে বই কমবে না। তবে এলডিসি হতে গ্র্যাজুয়েশন কেবল একটি সাইন পোস্ট বিজয় পোস্ট নয়। গ্র্যাজুয়েশনের দীর্ঘ উন্নয়নের ধাপ পেরিয়ে ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে চূড়ান্ত অর্জন না হওয়া পর্যন্ত গ্র্যাজুয়েশন হয়েছে বলা যাবে না। গ্র্যাজুয়েশন অর্জনের পর তা সাফল্যজনক ভাবে ধরে রাখা হচ্ছে প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং পরবর্তী টেকসই উন্নয়নের স্রোতধারা রক্ষা করাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

সম্প্রতি টঘঈঞঅউ-এর এক গবেষণায় দেখা যায় গ্র্যাজুয়েশন অর্জিত কিছু এলডিসি দেশের পর্বতসম ঋণের দায় আশঙ্কাজনকভাবে সতর্কতামূলক লাল ও হলুদ শিখার সংকেত দিচ্ছে, মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় ২ হাজার ৭০০ ডলারের নিচে উন্নয়নশীল কিছু দেশ গ্র্যাজুয়েশন যোগ্যতা অর্জনের পরবর্তী চার বছরে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে পাহাড়সম দায় নিয়ে প্রকট হুমকির সম্মুখীন। এসব দেশের গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশ প্রয়োজন পূর্বপ্রস্তুতি নিকে মনোযোগী হওয়া। এ ছাড়া অনমনীয় ঋণ জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বরাদ্দ, চলমান মেগা, ফাস্ট ট্র্যাক ও ২০০ কোটি টাকার উপরের প্রকল্প নিবিড় পর্যবেক্ষণ, দ্রুত রাজস্ব অর্জনকারী ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী প্রকল্প গ্রহণ, রপ্তানি পণ্যের বহুবিধ বৈচিত্র্যকরণ, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে স্থানীয় শিল্পের রেডিনেস নিশ্চিতকরণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের সমস্যা নিরসন, ম্যাক্রো ও মাইক্রো অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ তৈরি এবং ঋণ গ্রহণের পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে ঋণ প্রদাণকারী দেশে রূপান্তর হলে মসৃণ গ্র্যাজুয়েশন প্রত্যাশা করা যায়।

লেখক : অতিরিক্ত সচিব (অবসরপ্রাপ্ত), অর্থ মন্ত্রণালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close