আবু আফজাল সালেহ

  ২৩ অক্টোবর, ২০২১

দৃষ্টিপাত

সৈয়দপুর রেল কারখানার দিকে তাকাতে হবে

বাংলাদেশের চলমান রেল কারখানা তিনটি। পাহাড়তলী, সৈয়দপুর আর পার্বতীপুরে অবস্থিত এ কারখানাগুলো। দেশের সবচেয়ে বড় রেল কারখানা রয়েছে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে। এটি ১৮৭০ সালে স্থাপিত করে ইংরেজরা। এটির সক্ষমতা ছিল। এখনো আছে বলে প্রমাণও দিয়েছে। তবে জনবল সংকট, যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ না হওয়া, চুরি ইত্যাদি কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে এ অঞ্চলের তথা রেলের স্বপ্ন দেখানো এ কারখানাটি। কমে গেছে রেলের উন্নয়ন গতি। বর্তমান সরকার প্রচুর রেলের উন্নয়ন করলেও আগের ক্ষত শুকাতে আরো নজর বাড়ানো প্রয়োজন। সরকারের সদিচ্ছা সত্ত্বেও কারখানাটির যা উন্নয়ন হওয়ার কথা তা হয়নি অজানা কিছু কারণে। ছোট্ট একটি গ্রাম থেকে শহর হয় সৈয়দপুর। আর এখন দেশের শীর্ষ ব্যবসা কেন্দ্রের একটি সৈয়দপুর। হয়েছে বিমানবন্দর। এ অঞ্চলের উন্নয়নের ভরকেন্দ্র হচ্ছে রেল কারখানাটি। ব্রিটিশ আমল থেকে এ অঞ্চলের উন্নয়ন আবর্তিত হয়েছে এ কারখানা ঘিরেই। অথচ যার জন্য এত উন্নতি সেই রেল কারখানাটি রয়েছে চরম অবহেলায়। রাতের আঁধারে রেলের জিনিসপত্র চুরি হয় বলে শোনা যায়। আরো শোনা যায় রেলের কিছু স্থায়ী-অস্থায়ী লোকজনও এর সঙ্গে জড়িত। যদি তাই হয় তাহলে সরকারের উদ্যোগ সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত গতি পাবে না কারখানাটি। এলাকাবাসী আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আরো আন্তরিক হতে হবে, দেখাতে হবে দেশপ্রেম। জগদ্বিখ্যাত কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল কিন্তু এভাবেই ধ্বংস হয়ে গেছে।

প্রায় ১৫০ বছর আগে ব্রিটিশ সরকার ১১০ একর জায়গার ওপর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। বিশাল রেলওয়ে কারখানাটি, যা আজও বাংলাদেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা হিসেবে পরিচিত। ১৮৭০ সালে আসাম বেঙ্গল রেলপথ ঘিরে ব্রিটিশরাজ প্রতিষ্ঠিত সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা প্রতিষ্ঠার সময় শত শত মেশিনের শব্দ ও কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর পদচারণে মুখর ছিল। শুরুতে ওই কারখানাটিতে মঞ্জুর করা পদ ছিল চার হাজার। স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকার ২০০৩ সালে ওই সংখ্যা কমিয়ে ১ হাজার ৬২১ জনে দাঁড় করায়। শুধু বিনিয়োগ ও লোকবল ঘাটতির কারণেই ইঞ্জিন, ক্যারেজ ও ওয়াগন মেরামতের সুযোগ থাকলেও অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে বাইরে থেকে আমদানি ও মেরামত করতে হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, আমাদের সৈয়দপুর কারখানাটি আজ ধ্বংসের মুখে। চলছে ধুঁকতে ধুঁকতে। ১৮৭০ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলপথকে ঘিরে। এরপর ১৯০৩ সালে কারখানাটি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ও মালবাহী গাড়ি এবং স্টিম লোকোমোটিভ মেরামত কারখানায় রূপান্তরিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৩ সালের দিকে কারখানায় বিভিন্ন মেশিন শপ স্থাপন করে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ যাত্রীবাহী গাড়ি মেরামত ও সংশিষ্ট যন্ত্রাংশ উৎপাদনের সুবিধাসহ পূর্ণাঙ্গ কারখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সৈয়দপুর কারখানায় আছে ২১টি শপ (উপ-কারখানা)। কারখানাটি পশ্চিম রেলের ব্রডগেজ ও মিটারগেজ রেলপথের যাত্রীবাহী বগি (ক্যারেজ), মালবাহী বগি (ওয়াগন) এবং পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের স্টিম রিলিফ ক্রেনের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ এবং আয়ুষ্কাল ঠিক রাখার পাশাপাশি কোচের গতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া এখানে ক্যারেজ, ওয়াগন ও লোকোমোটিভের ১ হাজার ২০০ রকমের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির সমতা আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। এ কারখানাটির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি কখনো।

তথ্য মতে, ১৯৯১ সালে রেলওয়ে রিকভারি প্রোগ্রামের আওতায় রেলওয়ের লোকবল ৫৮ হাজার থেকে ৩৫ হাজারে নামিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে সৈয়দপুর রেল কারখানায় শ্রমিক সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। নতুন লোকবল নিয়োগের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। জানা গেছে, কারখানায় কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীর মঞ্জুর করা পদ আছে ৩ হাজার ১৭১টি। কারখানায় মঞ্জুর করা প্রায় ৬০-৭০ ভাগ শূন্য পদ। শ্রমিকের অভাবে কাজের পরিধি কমে যাওয়ায় যে অল্পসংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছে, তারাও অলস সময় পার করছে। কারখানায় নিয়োজিত অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বয়স ৫০-এর ওপরে চলে গেছে। এরমধ্যে কর্মকর্তাদের শতকরা ৭০ ভাগ, আর কর্মচারীদের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগের বয়স ৫০-এর ওপরে। এরমধ্যে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ২৩০ জন অবসরে গেছেন এবং ২০২১ সালে ১৫০ জন অবসরে যাবে। এতে করে কারখানায় বিদ্যমান জনবল সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করবে। অনেক ক্ষেত্রে মামলা চলমান আছে। এতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের অধিক আন্তরিক হয়ে মামলার ঝামেলা মিটাতে হবে। অনেক সময় ব্যক্তিগত বা মুষ্ঠিমেয় কিছু লোকের স্বার্থের জন্য বা সরকারি সিদ্ধান্তে কিছু লোকের আঘাত হানতে পারে ভেবে ইচ্ছাকৃত মামলাও হয়ে থাকে। এতে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সত্যিকারের সমস্যা বের করে উদ্যোগী হতে হবে। অবশ্য নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বরাদ্দ কম। কারখানায় সময়মতো প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সরবরাহও মিলছে না। মালামাল ক্রয়ের দরপত্র প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতায় এ অবস্থা তৈরি হয়। নিম্নমানের মালামাল সরবরাহের ফলে কাজের মানও রক্ষা করা যাচ্ছে না। ওইসব নিম্নমানের মালামাল ব্যবহারে অতিরিক্ত জনবল, শ্রমঘণ্টা ও বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। ১০০ বছরের পুরোনো ও মেয়াদ উত্তীর্ণ সনাতন পদ্ধতির মেশিনে চলছে কারখানার মেরামত কাজ। বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়ম অনুসারে, প্রতিটি রেল কোচ চার বছর পর পর পিরিওডিক্যাল ওভারহোলিং (পিওএইচ), ১২ বছর পর পর জেনারেল ওভারহোলিং (জিওএইচ) করার কথা। এ কারখানায় বরাদ্দ, জনবল সংকট ও কাঁচামালের অভাবে কোচ মেরামতে ওভারডিউ হয়ে পড়েছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে ২৩০টি নতুন মিটার গেজ কোচ নির্মাণ করা হয় এ কারখানায়। নতুন কোচ নির্মাণে ব্যবহার করা হতো সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি। দেশীয় মালামাল ব্যবহার করায় খরচ কম হতো। আমদানি মূল্যের অর্ধেক মূল্যে সৈয়দপুর রেল কারখানায় নতুন যাত্রীবাহী কোচ নির্মাণ করা হতো। কিন্তু ১৯৯৩ সালে অজ্ঞাত কারণে সৈয়দপুর কারখানার ক্যারেজ কনস্ট্রাকশন শপ বন্ধ হয়ে যায়।

তথ্য মতে, সৈয়দপুর ওয়ার্কশপে বছরে ৯০০ কোচ ও ২ হাজার ৫০০ ওয়াগন মেরামতের সক্ষমতা থাকলেও ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাত্র ১৪৭টি কোচ ও ১৬৮টি ওয়াগন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৩২টি কোচ ও ১৪৮টি ওয়াগন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১২৬টি কোচ ও ১৫১টি ওয়াগন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২৬টি কোচ ও ১৪৭টি ওয়াগন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২৩টি কোচ ও ১১৯টি ওয়াগন মেরামত করা হয়। অথচ ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ওয়ার্কশপটিতে ৩২০টি কোচ ও ২৫৪টি ওয়াগন মেরামত করা হয়েছিল। এতেই বোঝা যায়, কারখানাগুলোর কার্যক্ষমতা কতটা কমছে। বেশির ভাগ মেশিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর পেরিয়ে ২০০ বছরে গিয়ে ঠেকেছে! বর্তমান সরকার রেলের গতি ফিরিয়ে এনেছে। বর্তমান সরকার গণপরিবহনের অন্যতম সেবা খাত হিসেবে রেলওয়েকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। আর এ কারখানার জনবল নিয়োগ দিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিসি শপ পুনরায় চালু করে কম খরচে অত্যাধুনিক নতুন ক্যারেজ নির্মাণ করা সম্ভব। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ দেশের অর্থও সাশ্রয় হবে। তিনি সিসি শপ চালু ও কারখানায় জরুরি ভিত্তিতে জনবল করা দরকার। কারখানা চাঙ্গা রাখতে হলে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ এবং পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্প নিলে ২০১২ সাল থেকে কারখানায় আধুনিকায়নের কাজ হয়। ১৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের অধীন কারখানার ১৭টি শপ সংস্কার, ওয়াটার পাম্প স্থাপন, কারখানার ভেতরের রেলপথ সংস্কার, বিভিন্ন শপে প্লান্টস ও মেশিন এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম স্থাপনের কাজ শুরু হয়। তড়িঘড়ি করতে যেয়ে লালমণি এক্সপ্রেসের কোচের (ক্যারেজ) মান আশানুরূপ হয়নি। অথচ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে জানা যায়। এ কারখানাগুলো প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল রেলওয়ের লোকোমোটিভ, ক্যারেজ ও ওয়াগনের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ, আয়ুষ্কাল ঠিক রাখার পাশাপাশি গতিশীলতা বজায় রাখা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের কারখানাগুলোতে লোকবল সংকট, বাজেট স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাব, পুরোনো যন্ত্রপাতি এবং আধুনিক মেশিনারিজের অভাবে কাজের স্বাভাবিক গতি বজায় রাখতে পারছে না। যা যাত্রীসেবা প্রদান ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে অন্তরায়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়নে এবং কোচ, ওয়াগন ও লোকোমোটিভের সচলতা এবং আয়ুষ্কাল ঠিক রাখতে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল নিয়োগ, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সরবরাহ এবং অর্থ বরাদ্দ করা একান্ত প্রয়োজন।

মোদ্দাকথা জনবল সংকট, বাজেটবরাদ্দের অপ্রতুলতা, মামলা, যন্ত্রাংশ-কাঁচামাল ক্রয়ে দীর্ঘসূত্রিতা, সংশ্লিষ্ট কিছু লোকের গাফিলতি ইতদ্যাদি কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে রেল খাত। সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। প্রচুর বরাদ্দ দিচ্ছে সরকার। তবে মৃতপ্রায় রেলকে জাগ্রত করে গতিশীল করতে সরকারকে বাজেট বরাদ্দের সঙ্গে সঙ্গে কঠোর নজরদারি করতে হবে। কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। জনশ্রুতি রয়েছে- রেলের ভেতরই কালো বিড়াল আছে। এগুলোকে শনাক্ত করতে পারলে ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে সরকারের মহতী উদ্যোগ সার্থক হবে বলে মনে করি।

সৈয়দপুর কারখানায় প্রায় ১ হাজার ২০০ প্রকাশ খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনে সক্ষম। এগুলো আমদানি করতে গেলে খরচ ও সময় অনেক বাড়ে। কাজের অভাবে শ্রমিকরা অলস পড়ে থাকে এবং তখন মাথায় খারাপ বুদ্ধিও আসে। এতে দীর্ঘসূত্রিতা হয় ও খরচ বাড়ে। রেলসেবা বিঘিœত হয়। সরকারের বদনাম হয়। এসব বিষয়ে সরকারকে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। নতুন আরো রেল কারখানা স্থাপন করতে হবে। পুরোনোগুলোকে স্বয়ংস¤পূর্ণ করতে হবে। জনবল সংকট নিরসনে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা জানি, রেল একটি আরামদায়ক ও তুলনামূলক সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থা। পর্যটনকে আকর্ষণীয় ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করাতে রেলের বিকল্প নেয়। বিদেশিরা রেলকেই নিরাপদ ও আরামদায়ক মনে করেন। দিন দিন রেলের চাহিদা বাড়ছে। রেলের গতি ফিরেছে। রেললাইন সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এজন্য দরকার হবে বগি। দরকার হবে মেরামতের। রেল কারখানাকে শক্তিশালী করতে হবে। নাহলে আমদানিনির্ভর হলে খরচ বাড়বে। সময় খরচ হবে। রেলসেবা বিঘ্নিত হবে। রেলের কাক্সিক্ষত ভিশন পূরণ হবে না।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close