সাধন সরকার

  ১৩ অক্টোবর, ২০২১

মুক্তমত

শিক্ষাক্রমে পরিবেশ ও জলবায়ু ঘনীভূত হোক

জাতীয় শিক্ষাক্রমের নতুন রূপলেখার খসড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়েছেন। ২০২৩ সাল থেকে শিক্ষাক্রমের আলোকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু হবে। ধারণা করা হচ্ছে নব্য শিক্ষাকাঠামোয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পরীক্ষার সংখ্যা কমবে, মুখস্থ বিদ্যা বন্ধ হবে, হাতে-কলমে অনুশীলন বাড়বে। সবদিক বিবেচনায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে বেকারের সংখ্যা হ্রাস পাবে। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই শঙ্কিত। শিক্ষাক্রম বা কারিকুলাম প্রণয়নের চেয়ে বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষা যেন শুধু সনদের জন্য না হয়ে জীবনমুখী হয়- এই ভাবনাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

গত কয়েকটি শিক্ষা কাঠামোয় দেখা গেছে, চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষার মিল ছিল খুব সামান্যই। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে বছরের পর বছর। আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নদী, জলাশয়, সামগ্রিক প্রকৃতি-পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী ও প্রকৃতি-পরিবেশ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু নদী দখল-দূষণ ও ভরাট থামছে না। সময়ের পরিক্রমায় অনেক নদণ্ডনদী আজ বিপন্ন। বনভূমি কমছে ছাড়া বাড়ছে না। কেন নদণ্ডনদী ও প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস হলে শিক্ষার্থীদের মন কাঁদে না, কেন তারা বিচলিত হয় না? তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কী শিক্ষা দিল শিক্ষার্থীদের? বইয়ের পড়ার সঙ্গে বাস্তব জগতের তাহলে মিল নেই। এখনকার প্রজন্ম নদণ্ডনদী ও প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায় যেন অনেক বেশি উদাসীন। পাশের নদী-জলাশয় ভরাট, দখল-দূষণের ক্ষেত্রে ও গাছপালা কাটা হলেও সবাই যেন উটপাখির মতো মাটিতে মুখ লুকিয়ে থাকে।

আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে জাগিয়ে তুলতে পারছে বলে মনে হয় না। সময় এসেছে নতুন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জাগিয়ে তোলার। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে শিক্ষার্থীদের নদী-জলাশয়ের সুরক্ষা, প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। কেননা আজকের শিক্ষার্থী আগামী দিনের দেশের রক্ষক। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে কোনো দেশ-ই এখন নিরাপদ নয়! পৃথিবীব্যাপী প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। মূলত জলবায়ুগত সমস্যার কারণে উন্নয়ন টেকসই ভিত্তি পাচ্ছে না। জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কমানো জরুরি হয়ে পড়েছে।

নিজেদের চোখের সামনে ‘জীবন্ত সত্তা’ নদণ্ডনদী ধ্বংস হতে থাকবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব- এটা হতে পারে না। যে শিক্ষাব্যবস্থা দেশের নদণ্ডনদী, প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার বাস্তবিক শিক্ষা দেয় না; সে শিক্ষাব্যবস্থা প্রকৃত শিক্ষাব্যবস্থা নয়। শিক্ষাক্রমে ব্যবহারিক কাজে নদী-জলাশয় রক্ষার গুরুত্ব ও প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার সম্পর্ক তুলে ধরতে হবে। নদী-জলাশয় দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাতে হবে। সম্প্রতি হাইকোর্ট দেশের সব জলাভূমি রক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করার নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জলাভূমি রক্ষার ওপর প্রতি দুই মাস পরপর এক ঘণ্টার ক্লাস নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এমন সব প্রকৃতিবান্ধব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হোক এটাই কাম্য। এখনকার প্রজন্ম তথা শিক্ষার্থীদের যদি প্রকৃতি-পরিবেশ ও নদণ্ডনদী রক্ষায় সচেতন করা যায় তাহলে আগামী দিনে এই শিক্ষার্থীরাই হবে দেশের সামগ্রিক প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার সবচেয়ে বড় পাহারাদার।

প্রত্যেক শিক্ষার্থী এক একটি সম্পদ। শিক্ষার্থীরা এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা স্কুলে ছাদবাগানের যতœ নিচ্ছে, বিদ্যালয়ের চারপাশ সুন্দর করে সাজাচ্ছে। আবার শিক্ষার্থীরাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কোনো না কোনোভাবে ভুগছে। উন্নত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ শিশুকাল থেকে করে থাকে। শিশু ও কিশোর শিক্ষার্থীদের যদি ছোটবেলা থেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, জলাশয় সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা, বৃক্ষরোপণের মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায় তাহলে এই কোটি কোটি শিক্ষার্থী ছোটবেলা থেকেই নিজেদের টেকসই ভবিষ্যৎ ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা সম্পর্কেও সচেতন হবে। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা জানবে কোনো ভালো কাজে লজ্জা নেই, নিজেদের ভবিষ্যৎ আমাদেরই গড়তে হবে। পরিবেশপ্রেমী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে এই শিক্ষার্থীরাই সচেতন ও যোগ্য নাগরিক হয়ে দেশের হাল ধরবে। প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণের কথা তখন আর গলা ফাটিয়ে বলা লাগবে না। এমনিতেই তখন সবাই প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণে এগিয়ে আসবে। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তাদের শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনামাফিক গড়ে তুলতে পারলে দেশটা অচিরেই বদলে যাবে।

লেখক : শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close