সিনথিয়া সুমি

  ১৪ এপ্রিল, ২০২১

পর্যালোচনা

পহেলা বৈশাখ ও বাংলার সংস্কৃতি

পহেলা বৈশাখ হচ্ছে লোকজের সঙ্গে নাগরিক জীবনের একটি সেতুবন্ধ। ব্যস্ত নগর কিংবা গ্রামীণ জীবন যেটাই বলা হোক না কেন, এই নববর্ষই বাঙালি জাতিকে একত্র করে জাতীয়তাবোধে। এ অনুষ্ঠান পরিণত হয় প্রত্যেকটি বাঙালির কাছে শিকড়ের মিলনমেলায়। ধর্ম, বর্ণ সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। আসছে বাঙালির প্রাণের উৎসবের দিন পহেলা বৈশাখ। বছরের প্রথম দিনটি বাঙালিরই শুধু নয়, বাংলা ভাষাভাষী আদিবাসী ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের জীবন-জগতে স্বপ্নময় নতুন বছরের শুভ সূচনা ঘটায়। জীর্ণ-পুরোনোকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করে বাঙালি জাতি। পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মেতে থাকত পুরো জাতি। তবে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকার বাংলা নববর্ষের সব অনুষ্ঠানে জনসমাগম বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে। এমন অবস্থায় পহেলা বৈশাখ ঘিরে প্রতি বছর যে রকম জমজমাট প্রস্তুতি থাকে, এবারে সে চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন।

পহেলা বৈশাখ, বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহ দেশ-বিদেশে বসবাসরত প্রত্যেকটি বাঙালি নববর্ষ হিসেবে পালন করে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন প্রাণের উৎসব। বাঙালি এই প্রাণের উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে আবহমান বাংলার কৃষি। গ্রামীণ মেলাগুলো পরিণত হয় উৎসবে। এই উৎসবের রং একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নিয়েছে বারবার। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা; যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেসকো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। এ মর্যাদা দেওয়ায় আমরা গৌরববোধ করি। পহেলা বৈশাখ তাই কেবল একটি তারিখ মাত্র নয়, বাঙালির উৎসবের দিন। এই দিন উপলক্ষে সরকার বাংলাদেশের চাকরিজীবীদের জন্য ঈদ-পূজার বোনাসের মতো ‘বৈশাখী ভাতা’ চালু করেছে। এটিও বড় আনন্দের কথা।

এখন যেমন বাংলা নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, একসময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল কৃষির। কারণ কৃষিকাজ ছিল বিশেষ ঋতুনির্ভর। ফসল বোনা, ফসলের সময়ভিত্তিক যতœ বা পরিচর্যা, ফসল কাটাসহ যাবতীয় কৃষিকাজ বাংলা সন-তারিখ পঞ্জিকা অনুযায়ী নিষ্পন্ন করা হতো। বাংলায় হরেক রকম মেলার দিন-তারিখও নির্ধারিত ছিল বাংলা সনের সঙ্গে। শুধু ফসল আর উৎসব নয়, বাঙালির কৃষকের পারিবারিক ও সামাজিক কাজকর্ম, বিবাহ, জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের সব বিষয়েই বাংলা সন ছিল একক ও অনন্য। ভারতবর্ষে খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা তথা ফসলি সন ১৫৫৬ সালের ১৪ এপ্রিল প্রবর্তন করেন। তবে শুরুর দিন কিন্তু ১ সাল ছিল না, ছিল ৯৬৩ সাল। তখন এ দেশে হিজরি সাল প্রচলিত ছিল। হিজরি বছরটিকে ঠিক রেখেই নতুন একটি বর্ষপঞ্জি চালু করা হয়। বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরি ও খ্রিস্টীয় সালের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরি সাল চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সাল ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরি সালে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে। আর বাংলা সনের দিন শুরু হয় ভোরে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বর্তমান পরিচিত পান্তা খাওয়া বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব। বাংলা সন ও বাঙালির ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির অবস্থান বর্তমান বাংলাদেশে আর আগের মতো নেই। এখন মানুষ লেখাপড়া শিখছে। গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যে নানা উপাদান যুক্ত হয়ে নতুন গতিবেগ সঞ্চার হয়েছে এবং এতে অনেকের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে, হাতে নগদ পয়সা আসার উৎস সৃষ্টি হয়েছে। ফলে জীবনধারার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটেছে সামাজিক রীতিনীতি ও অভ্যাসের। এই পরিবর্তনের ফলে বাঙালির ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির উপাদান এবং জীবনযাত্রার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বাংলা সনও আর এখন একাধিপত্য করতে পারছে না। বরং গ্রামজীবনের নতুন ধারা বা শহরের বাস বা বিদেশে চাকরিবাকরির সুবাদে ইংরেজি সালের ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু আমাদের জাতিসত্তায় আছে বঙ্গাব্দ। বাংলা সন কিংবা বঙ্গাব্দ বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। বাংলা সনকে উদ্যাপন করা মানে নিজের অস্তিত্বকেই স্বীকার করা। নগর সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ কেবল এক দিনের উৎসব-আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং জাতীয় সংস্কৃতিতে এর প্রভাব এখনো অনস্বীকার্য। বিশ্বের সব জাতিই নিজ সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বর্ষবরণ পালন করে।

আমাদের দেশে অনেকে পহেলা বৈশাখে নববর্ষের উন্মাদনায় বাউল বা বৈরাগীর বেশ ধারণ করে। কিন্তু যাদের কারণে, যাদের শ্রমে, যাদের মেহনতে, যাদের ঘামে, যারা রোদে-পুড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে, ঝড়ের সঙ্গে মাঠে লড়ে, ঝড়ঝাপটা, বন্যা-খরা-দুর্যোগ সামাল দিয়ে মাঠে ফসল ফলায়; সেসব খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের খবর আমরা কজনে জানি বা রাখি। যারা দেশ জাতি ও সমাজের মানুষের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগান দেন, তারা আমাদের কৃষক জনগোষ্ঠী। বাংলা নববর্ষের এই লগ্নে একবারও কি ভাবা যায় না, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকরা কেমন আছেন? উৎপাদন ব্যয় কতটুকু বেড়েছে? তবে এটা ঠিক বাংলা নববর্ষের ভেতর দিয়ে মূলত দেশের আপামর জনসাধারণ নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করে চলেছে। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দেশের নর-নারী এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নতুবা আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলার ঐতিহ্য লোকসংস্কৃতির কিংবা বাংলা ঋতুর কথা ভুলেই যেত। করোনাভাইরাস মোকাবিলা করে বাংলা নতুন নববর্ষে অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। দেশ ও জাতির মঙ্গলে জনগণের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত দেশপ্রেম জাগ্রত হোক, খুলে যাক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। বাংলা নববর্ষে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close