আকমল হোসেন

  ০৮ মার্চ, ২০২১

পর্যবেক্ষণ

নারী ও তার সামাজিক অবস্থান

কর্মজীবী নারীদের প্রতিদিন আট ঘণ্টা শ্রমদিবস এবং মজুরি বৃদ্ধির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দিবসটি পালনের সূত্রপাত ঘটলেও আজ বিশ্বব্যাপী নারী দিবস পালিত হচ্ছে নারী মুক্তির আকাক্সক্ষাকে সামনে রেখে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারী মুক্তির জন্য নতুন নতুন প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে প্রতি বছরই দিবসটি পালিত হয়। এ বছর ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব/গড়বে সমতার বিশ্ব’ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে পালিত হচ্ছে বিশ্ব নারী দিবস। তবে শ্রেণিবিভক্ত এবং ভোগবাদের আধিপত্যবাদী সমাজে এই স্লোগানের সর্বজনীনতা যে নেই, সে বিষযটি পরিষ্কার। পৃথিবীর প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের প্রায় অর্ধেকই নারী। সমাজেরই একটা অংশ, আমরা সবাই একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। গঠন প্রকৃতির সামান্য ভিন্নতা ছাড়া অন্য কোনো দিক থেকে নারীকে পুরুষ থেকে আলাদা করা যায় না, আধুনিক সমাজের অগ্রসরমান চিন্তাধারার মানুষগুলো এটাই বলে এবং সেই আঙ্গিকেই পৃথিবীর অনেক দেশে সংবিধানে নারী অধিকার সংযোজিত হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও এমন বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম, শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্য দেশেও।

সৃষ্টির শুরুতে পুরুষ, সমাজ শাসনের যে লাগাম কব্জা করেছিল, সেটা আজও ছাড়েনি। নেতার পরিবর্তন হলেও নীতির পরিবর্তন হয়নি। তাই শাসক নারী হওয়ার পরও তার সাম্রাজ্যে নারী আজও বিভিন্নভাবে অধিকার বঞ্চিত, নির্যাতিত। প্রয়োজনে পুরুষ নারীকে বাহুডোরে বেঁধেছে আবার ছুড়েও দিয়েছে, তাদের শুধু ভালো লাগা আর না লাগার কারণে। বহু বিবাহ ও তালাক প্রথা সেটাই মনে করে দেয়। নারীদের নিয়ে এমন খেলা অনেকেই খেলেছেন, এখনো খেলছেন। নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার অভাবই হোক আর প্রচলিত বিধি ব্যবস্থার জাঁতাকলের কারণেই হোক, নারী আজও নারী, যেন সে মানুষ হয়নি অথবা মানুষ হতে চায় না।

প্রতিটি জাতি ও সম্প্রদায় তার লোকাচার ও সংস্কৃতির মাধ্যমে পরিচিত হবে, এটা দোষের কিছু নয়। পৃথিবীর ৩ হাজার প্রকার ভাষাভাষীর প্রতিটির অবস্থান সংখ্যার বিচারে ক্ষুদ্র আর মানুষ বিশাল এক জনগোষ্ঠীর সদস্য। সেখানে সংকীর্ণতা পরিহার করে মানুষ হতে পারে বিশ্ব পরিবারের একজন সদস্য। একসময় নারী ছিল সামাজিকভাবে উপেক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাহীন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অবরুদ্ধ। নারীর ছিল না ভোটাধিাকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নারীর গতরই শুধু নয়, নারী মুখের কথাও পর পুরুষে শুনবে এমনতর ভাববাদী বিধান। পর্দার বেষ্টনী, আইবুড়ির অপবাদ, মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণে চিতায় ঝাঁপ এ প্রবণতা কমলেও সমাজ থেকে মুছে যায়নি। নারী যতই গুণী হোক সাক্ষ্য প্রদানে এক পুরুষের সমান হতে দুই নারী জরুরি। খ্রিস্টধর্মে বয়স বেশি হওয়ার পর অবিবাহিত নারীদের আইবুড়ি অপবাদে হত্যার স্বীকার হতে হয়েছে। হিন্দু ধর্মের গুরু তুলসী দাসতো বলেছেনই, ‘নারী শিশুকালে থাকবে বাবার অধীন, বয়স্ককালে থাকবে স্বামীর অধীন, পতিদেবের মৃত্যুর পর সে হবে ছেলের অধীন; নারীকে কোনোভাবেই স্বাধীনতা দেওয়া যাবে না।’ অনেক ধর্মে নারীকে পাপের আঁধার বলে অভিহিত করেছে। বাবার সম্পত্তিতে মেয়ের অংশীদারত্ব ছেলের অর্ধেক। নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়, এমন বিধান থাকলে নারী অধিকার নিশ্চিত কতটুকু সম্ভব? মেয়েদের শারীরিকভাবে দুর্বল রাখতে আফ্রিকার অনেক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে মেয়েদের খাতনা করানো হয়, প্রথম মাসিক হওয়ার পরই মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার রেওয়াজ নারী নির্যাতনের আরেক উপায়। ১২ বছরের মাসিক হওয়া মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিচ্ছে ২৫-৩০ বছরের এক যুবককে, জেলে না গিয়েও মেয়েটি স্বামীগৃহে প্রতিদিনই জেল খাটে। নারীদের এহেন জেল খাটা থেকে মুক্তির চেষ্টা করলেও আমরা মুক্তি দিতে পারিনি। ধর্মীয় সংকীর্ণতা, মৌলবাদীদের ফতোয়া ও দোড়রার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত নারী।

পোশাকশিল্পে ৯০ শতাংশ শ্রমিক নারী। মজুরিবৈষম্য, কাজের সময়ের লাগামহীনতা, নিরাপত্তাহীনতা এসব শ্রমিকদের নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি আছে প্রতিকার নেই। পুঁজিবাদ নারীকে যেভাবে মেলে ধরেছে, তাতে মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার যেমন নিশ্চিত হয়েনি, তেমনিভাবে মানবিক মর্যাদাও বাড়েনি। যত দিন তার জৌলুস আছে, তত দিন তার কদর আছে, এইতো পুঁজিবাদী নারী স্বাধীনতা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্ষমতার মসনদে নারী যতবারই আসুক তাতে প্রকৃত অর্থে নারী অধিকার নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর ইতিহাস সে কথাই বলে। এই সত্যকে সততার সঙ্গে বোধ ও বিবেচনায় না আনলে নারীর মুক্তি নিশ্চিত হবে না। শুধু নারীরাই বঞ্চিত নয়, দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৯ কোটি দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ৪.৫ কোটি, আর ৪০ লাখ উচ্চবিত্ত। ৪৯ বছরে দেশে নতুন সম্পদের সৃষ্টি হয়েছে, তবে সম্পদের সুষম বণ্টন না হওয়ায় বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। আয়বৈষম্য বাড়তে বাড়তে আজ আকাশ আর পাতালের অবস্থানে। গরিব ও ধনীর আয়বৈষম্যের অনুপাত ১:৮৪। এই অবস্থায় সম্পদ বৃদ্ধি যতই হোক সমাজ থেকে বঞ্চনা কমবে না, অর্থনৈতিক উন্নয়নও আশা করা যায় না। সমাজের বৃহৎ অংশের মানুষ যেখানে অধিকার বঞ্চিত; সেখানে নারী অধিকার ভিন্ন করে না দেখে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য একটা কাফেলায় সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অর্থনৈতক মুক্তি ও ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্তির জন্য এনজিওরা কাজ করলেও সফলতা অনেকদূর। আর এই ব্যবস্থাপনায় দরকার স্বচ্ছ আলোর। সেই আলো এখনো নাগালের বাইরে। তাই নারীদের করুণার পাত্র হয়ে অন্যের কাছে আবেদন-নিবেদনের চেয়ে অধিকার আদায়ের লৌহ দৃঢ় ঐক্য গড়াই জরুরি। ধর্মীয় শাসন ও কুংসস্কার মুক্ত হতে সেক্যুলারিজম রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত হতে সমাজবাদী অর্থনীতি এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সমাজতান্ত্রিক সমাজের অন্বেষণ জরুরি। নারী শুধুই ক্ষমতা শূন্য, ক্ষমতার আসন অলংকৃত করলে নারী মুক্তি আসবে এমন আশা নিরাশার নামান্তর। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের নারীরা নিজের প্রতি আস্থাহীন বলেই মনে হয়। তারা এখনো পরাধীন ও আশ্রিত তাদের বেশ-বসনে মনে হয়। গয়না, পোশাক-আশাক আর প্রসাধনীতে অনেকেই নিজেকে স্বাধীন বিবেচনা করেন, আসলে এগুলো দ্বারা নারীকে ভুলিয়ে রাখার একটাই মাধ্যম। হাতের বালা, কানের দুল, নাকের নোলক, গলার মালা জেলখানার কয়েদিদের পরাধীনতার শৃঙ্খল বলে অনেকেরই ধারণা। পুরুষ শাসিত সমাজে বহু নারীতে আসক্ত শাসক ও সমাজপতিরা ঘরের বিবিদের মুখ বন্ধ করতেই নারীকে বেশভূষায় সজ্জিত করেছিল বলে অনেকেরই ধারণা। নারীরা আজও সেটা বোধে আনছে না।

নারী শুধু পুরুষ শাসিত সমাজের আইনকানুনের কারণেই নিষ্পেষিত নয়, সে নিজেও নারী অধিকারের অন্তরায়, কারণ নারী পুরুষ হিসেবে না থেকে সবাই মানুষ হলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। তাইতো কবি বলেছেন, ‘আবার তোরা মানুষ হ’। তাই বঞ্চিত নারী সমাজ যদি মুক্তি চায়, তবে তাকে প্রথমেই মানুষ হিসেবে ভাবার প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, সে বঞ্চিত মানুষ কি না। তৃতীয়ত, সে বঞ্চনা থেকে মুক্তি চায় কি না, সেটা ঠিক করতে হবে।

লেখক : অধ্যক্ষ, লালমাটিয়া কলেজ

সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) কেন্দ্রীয় কমিটি

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close