সৈয়দ ফারুক হোসেন

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২১

মুক্তমত

প্লাস্টিক ও করোনাবর্জ্যরে বিপদ

বৈশ্বিক মহামারির এ সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে উদ্বেগের চিত্র হলো ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও করোনাবর্জ্যে নদ-নদী ও সাগরের পানি মত্রাতিরিক্ত দূষিত হচ্ছে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে মানুষের ব্যবহৃত মাস্ক ও গ্লাভসের ৯২ শতাংশ খাল-বিল-নালা হয়ে নদীতে পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, সামগ্রিকভাবে প্লাস্টিক দূষণের দিক থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা, পদ্মা ও যমুনা নদী বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিলের গত আগস্টের হিসাবে, বিশ্বে গত এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে ১২ হাজার ৯০০ কোটি মাস্ক ও ৬ হাজার ৬০০ গ্লাভস নদী হয়ে সাগরে পড়ছে। এর আগে বিশ্বে বছরে ৮০ কোটি টন প্লাস্টিক নদী হয়ে সাগরে জমা হতো, যা বছরে ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি ও ১ লাখ মাছের মৃত্যু ডেকে আনে। বঙ্গোপসাগরে ৩০০ ধরনের প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে করা ‘উৎস থেকে সাগরে’ শীর্ষক চলমান এক গবেষণায় আরো ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

গত জুনে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি ‘বিশ্বের প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণের দিক থেকে তা বিশ্বে পঞ্চম। এই বর্জ্যের উৎস গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা হয়ে এগুলো সাগরে যায়। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের জল-স্থলে বর্তমানে ৬৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। প্রতিদিন এর সঙ্গে তিন হাজার টন যোগ হচ্ছে। সংস্থাটি দেশের পরিবেশের জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি হিসেবে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগকে চিহ্নিত করেছে। তারা বলছে, দেশে যেখানে জৈব বর্জ্য বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য বৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ শতাংশ।

প্লাস্টিকের ভয়াবহ দূষণ থেকে রক্ষা পেতে বিজ্ঞানীরা বিকল্প প্লাস্টিকের সন্ধান করছেন। বাংলাদেশে প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে পচনশীল পাটের ব্যাপক প্রচলনের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়াও অতি সম্প্রতি সন্ধান মিলেছে প্লাস্টিকের বিকল্প জৈব প্লাস্টিক। খাদ্যদ্রব্যের বাদ দেওয়া, পরিত্যক্ত অংশ থেকে জীবাণুর সাহায্যে বিয়োজিত করে, মাটিতে ও পরিবেশে মিশে যাওয়ার উপযুক্ত জৈব প্লাস্টিক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে হনলুলুর হাওয়াই ন্যাচারাল এনার্জি ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী জেন ইউ। এ ছাড়া জিন প্রযুক্তির সাহায্যে এমন এক উদ্ভিদের জন্ম দেওয়া হয়েছে, যা থেকে পাওয়া যাবে এক বিশেষ ধরনের পলিমার। এই পলিমারকে উত্তাপের সাহায্যে গলিয়ে তৈরি করা হবে প্লাস্টিক। এটাই জৈব প্লাস্টিক। এই জৈব প্লাস্টিক পরিবেশ দূষিত করবে না। কাগজের মতোই পরিবেশের সঙ্গে খাপে খাপে মিশে যাবে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন মানুষ সত্যিই দূষণমুক্ত এই প্লাস্টিক-পলিথিন ব্যবহার করতে পারবে। তার আগে ভাবতে হবে, এখন কী উপায়। ডিজিটাল যুগে প্লাস্টিক দূষণ থেকে পরিত্রাণে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পচনশীল ও অপচনশীল দ্রব্য আলাদা করার অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

এসডিজি অর্জনে নানাবিধ কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়ে এরই মধ্যে জাতীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ‘থ্রি আর’ (রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকেল) কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর পরিত্যক্ত প্লাস্টিক নবায়ন বা পুনর্নবীকরণ কৌশল গ্রহণ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পুনর্নবীকরণ কাজ বড়ই কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ কাজের জন্য সংগৃহীত প্লাস্টিক থেকে দূষিত পদার্থ শরীরে আসতে পারে। আবার পুনরায় ব্যবহারেও দূষণের আশঙ্কা রয়ে যায়। কারণ পুনর্নবীকরণে প্লাস্টিক গলানো হয়। গলানোর সময় ডায়াসিন, নাইট্রোবেঞ্জিন ইত্যাদি বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাস কারখানার শ্রমিক ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আবার পোড়ালেও বিপদ কম নয়। পোড়ানোর ফলে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত জৈব ও অজৈব গ্যাস উৎপন্ন হয়। এ সময় পরিবেশ দূষণকারী ডাই-অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড, সিএফসি, সিডিএফ, সিডিডি ইত্যাদি মারাত্মক গ্যাসীয় যৌগ প্রচুর পরিমাণে বের হয়। মানুষের শরীরে ক্যানসার সৃষ্টির জন্য এগুলোর যেকোনো একটাই যথেষ্ট। প্লাস্টিকমুক্ত বিশ্ব চাই এ স্লোগান আজ চারদিকে। প্লাস্টিক আজ বিশ্ব জলবায়ু সংকটের প্রধান কারণ। প্লাস্টিক পণ্য যতই সস্তা, সহজলভ্য ও আকর্ষণীয় হোক না কেন, এর ব্যবহার কমাতে হবে। না হলে এই দূষণ মানবজাতির জন্য বয়ে আনবে অনিবার্য মহাবিপর্যয়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী; বরিশালের কীর্তনখোলা; চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। এ ছাড়া নরসুন্দা, নবগঙ্গা, সুরমা, করতোয়া, ইছামতিসহ বিভিন্ন নদনদী পলিথিন দূষণের কবলে পড়েছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, হালদা ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে কয়েক ফুট পুরু পলিথিনের স্তর জমার কারণে নদীর দূষণ তো বটেই, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণে মাছের জীবনচক্র হুমকির মুখে পড়ছে! এ ছাড়া পলিথিন দূষণের কবলে পড়ে নদ-নদীর সার্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থাও হুমকির মুখে। শিল্প-কারখানায় প্লাস্টিক ব্যবহার চরমভাবে নিরুৎসাহিত করতে আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। এ ছাড়া পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধী জৈব-পচনশীল পাটজাত পণ্যের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্লাস্টিক নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের গণসচেতনতা আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে এটি আশার কথা। তবে শুধু আমাদের সচেতন হলেই চলবে না, বৈশ্বিকভাবে এই সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। করোনাবর্জ্যরে ব্যাপারে এখনই সতর্ক-সজাগ না হলে, ব্যবস্থাপনা সার্বিকভাবে করতে না পারলে বিপদাশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠবে।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার

জাগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close