reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

বিশ্লেষণ

সমুদ্র দূষণে প্লাস্টিকের প্রভাব

নাজমুন্নাহার নিপা

পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল; বলা যায় মহাবিশ্বের অন্যতম শক্তি ও সম্পদের আধার হচ্ছে সমুদ্র। সুমদ্রের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। কিন্তু দিন দিন এই প্রাকৃতিক সম্পদ প্লাস্টিকের মতো ভয়াবহ দূষণের গ্রাসে পরিণত হচ্ছে। প্লাস্টিক এমন একটি রাসায়নিক, যা পরিবেশের সঙ্গে মিশ্রিত হতে বা কারখানায় পুনর্ব্যবহার করতে দীর্ঘ সময় নেয়। বিভিন্ন প্লাস্টিকের সামগ্রী, বিশেষত পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিকের বোতল, গৃহস্থালির প্লাস্টিক কিংবা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে পুনর্ব্যবহার না করে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সমুদ্র দূষণ। প্লাস্টিক দূষণ মানবস্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে সামুদ্রিক পরিবেশের জন্যও মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পিওবিএ) দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, যেখানে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে ১৫ হাজার টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছিল, ২০১৮ সালে এটি ১২ লাখ টনে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি মাসে আনুমানিক ৩১২ টন প্লাস্টিকের উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু পরিবেশ থেকে কেবল ৯ শতাংশ প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার করা যায়, যা অত্যন্ত নগণ্য। এই ২৮ বছরে প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশিরা গড়ে ১৭ দশমিক ২৪ কেজি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করে; যার বেশির ভাগ বর্জ্য নদী হয়ে সমুদ্রে পতিত হচ্ছে।

উদ্বেগের বিষয় এই যে, ১৯৫০ সাল থেকে প্রায় ৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক অপরিশোধিত তেল থেকে তৈরি করা হয়েছে। এর প্রায় ৩০ শতাংশ এখনো বাড়ি, গাড়ি বা কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে। আরো ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পুড়ে গেছে; যা পরিমাণে যথেষ্ট নয়। প্লাস্টিকের বাকি ৬০ শতাংশ বর্জ্য বিশেষত সমুদ্রের পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বলছে, উৎপাদিত প্লাস্টিকের প্রায় ২ শতাংশ সমুদ্রের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। ২০১২ সালের এক সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বের সমুদ্রে প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের বর্জ্য রয়েছে। বর্তমান হিসাবে দেখা যায় যে, সর্বশেষ প্রায় ৮ মিলিয়ন প্লাস্টিক প্রতি এক দিনে সমুদ্রগুলোতে প্রবেশ করছে।

বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের ব্যবহার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি এক বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টনে পৌঁছে যাবে। প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ যে পরিমাণে মহাসাগরে প্রবেশ করে, তা যদি পরীক্ষা না করা হয়, তবে সাগরে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি তিন টন মাছের জন্য ১ টন প্লাস্টিক থাকতে পারে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের চেয়ে বেশি প্লাস্টিক থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য লোকেরা তাদের খাদ্য এবং পুষ্টি চাহিদা মেটাতে অবশ্যই সমুদ্রের ওপর নির্ভর করবে। এটি বলা যেতে পারে যে, সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ এবং প্রাণী মানব প্রোটিনের প্রয়োজনের একটি বড় অংশকে পূরণ করে। যার অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াবে সমুদ্র দূষণ।

সমুদ্রে সাধারণত দুইভাবে প্লাস্টিক দূষণ হয়ে থাকে। প্রথমত, জাহাজের মাধ্যমে প্লাস্টিক ভর্তি কনটেইনার সমুদ্রে নিক্ষেপ করা এবং দ্বিতীয়ত নদীর মাধ্যমে সাগরের মোহনায় জমা হওয়া। আমরা যখন ইচ্ছা-অনিচ্ছাকৃতভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলে দেই; তখন সেগুলো ড্রেনের মাধ্যমে খাল বা নদীতে গিয়ে পড়ে। এর কিছু অংশ নদীর তলদেশে জমা হয় আর কিছু অংশ পানি প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বের বেশ কিছু দেশ প্লাস্টিক বর্জ্য গভীর সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছে। এটি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী, সেই সঙ্গে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের ওপর চরম হুমকিরস্বরূপ।

উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বিশ্বের সাগর-মহাসাগরে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমছে। সমুদ্রের স্রোত প্লাস্টিক বর্জ্য ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূর-দূরান্তে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত জাপানিজ গবেষণা রিপোর্ট জানিয়েছে যে, ফিলিপাইনের অদূরে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম মারিয়ানা ট্রেঞ্চে প্লাস্টিক ব্যাগের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অপর এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক বর্জ্যরে ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশ বা মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাসের মাধ্যম হয়ে পর্বতচূড়ায় মিলছে। বায়ুদূষণের অন্যতম ক্ষতিকর উপাদান যে ভাসমান বস্তুকণা, বিশ্বজুড়ে সে তালিকায় যোগ হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক।

লক্ষণীয় যে, সাগর এখন একটি প্লাস্টিকের ট্র্যাশবিনে পরিণত হয়েছে, যেখানে বিশ্বের প্লাস্টিক বর্জ্য কোনো দ্বিধা ছাড়াই পতিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়াতে, বঙ্গোপসাগর প্লাস্টিকের আবর্জনা এবং অন্যান্য দূষণকারী পদার্থে ভরাট। বিপুল পরিমাণে প্লাস্টিকের বর্জ্য উপকূলে জমা হয়। ফলস্বরূপ, এটি মাছের প্রজনন ফর্মের বাসস্থানকে বাধাগ্রস্ত করছে। যা সরাসরি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলছে এবং অনেক প্রজাতি দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের মতে, বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৮০০ প্রজাতি সামুদ্রিক ধ্বংসাবশেষ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এই ধ্বংসাবশেষের ৮০ শতাংশই প্লাস্টিকের। এটি অনুমান করা হয় যে, প্রতি বছর ১৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রের মধ্যে জমা হয়, যা প্রতি মিনিটে একটি আবর্জনাপূর্ণ ট্রাকবোঝাইয়ের সমতুল্য। সামুদ্রিক মাছ, পাখি, কচ্ছপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীরা প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষে জড়িয়ে পড়ে বা আক্রান্ত হতে পারে; যার ফলে তাদের দমবন্ধ হয়ে যায় এবং অনাহারে থেকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, সামুদ্রিক পাখিদের প্রায় ৯০ শতাংশ সরাসরি প্লাস্টিক দূষণের শিকার।

প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের প্যাথোজেন বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, যে প্রবালগুলো প্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসে তাদের ৮৯ শতাংশ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্লাস্টিক দূষণ সৈকতের সৌন্দর্যও নষ্ট করে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবাল ইতোমধ্যে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, সম্ভবত সৈকতগুলো শিগগিরই তাদের সৌন্দর্য হারাবে। প্লাস্টিকের ব্যাগ, জলের বোতল, স্ট্র এবং অন্য যেকোনো প্লাস্টিক পণ্য, যা একবার ব্যবহার করা হয় এবং পরে তা ফেলে দেওয়া হয়, এসব পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। আমাদের অবশ্যই নিয়মিত সৈকত পরিষ্কার করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এটি সমুদ্রের প্লাস্টিকের দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার অন্যতম সর্বাধিক প্রত্যক্ষ এবং ফলপ্রসূ উপায়। সামুদ্রিক পরিবেশে প্লাস্টিকের প্রভাব সম্পর্কিত বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ এবং জনসচেতনতা বর্তমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) প্লাস্টিকের সামুদ্রিক ধ্বংসাবশেষ এবং পরিবেশকে প্রভাবিতকারী অন্যতম প্রধান উদীয়মান বিষয় হিসেবে প্লাস্টিককে চিহ্নিত করেছে।

এদিকে বর্জ্য ও অন্যান্য পদার্থের ডাম্পিংয়ে সামুদ্রিক দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ৮৭টি দেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় সংক্ষিপ্ত লন্ডন কনভেনশন। সামুদ্রিক দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করা, দূষণ প্রতিরোধে বর্জ্য পদার্থ ও অন্যান্য বিষয়ের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল ওই কনভেনশনের লক্ষ্য। তারই ধারাবাহিকতায় কনভেনশনের সিদ্ধান্তগুলো আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার জন্য ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত হয় লন্ডন প্রটোকল। বাংলাদেশসহ ৫১টি রাষ্ট্র এতে সই করে। ২০০৬ সালের ২৪ মার্চ থেকে ৫১টি রাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত লন্ডন প্রটোকল কার্যকর হয়। সম্প্রতি, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লেট, গ্লাস, কাপ, বেলুন স্টিক, কটন বাড, চা-কফিতে চিনি বা দুধ মেশানোর দন্ড ইত্যাদির ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার কথা। জলাভূমি, সমুদ্র এবং উপকূল-সৈকতের দূষণ নিয়ন্ত্রণে একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিকের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপে প্রতি বছর প্রায় আড়াই কোটি টন (২৫ মিলিয়ন টন) প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে অন্তত দেড় লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য মহাদেশের নদ-নদী ও জলাশয়ে গিয়ে জমে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের (৮ এপ্রিল, ২০১৯) তথ্য বলছে, প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন পাত্র, পানি ও কোমলপানীয়র বোতল যথেচ্ছ ছুড়ে ফেলার প্রবণতা নদী-জলাশয়ের প্লাস্টিক দূষণের অন্যতম ইন্ধন। অন্যদিকে, সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী প্রধান কয়েকটি দেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা তাদের কর্মকান্ডে পরিবর্তন করবে।

উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণ কমানোর লক্ষ্যে ২০০২ সাল থেকে পলিথিন (এক ধরনের প্লাস্টিক) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন পণ্যে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পাটের ব্যাগের (সোনালি ব্যাগ) মতো পচনশীল পণ্যের ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু প্লাস্টিকের ব্যবহার যে হারে ছড়িয়েছে, তাতে এ ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল, বলছেন গবেষকরা। আইন করেও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে পরিবেশের ওপর প্লাস্টিকের নেতিবাচক প্রভাবও বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছেন কীভাবে পরিবেশে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাবকে কমিয়ে আনা যায়। আর এ কাজে সফল হলেই আমরা সমুদ্রে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে সক্ষম হব।

লেখক : শিক্ষার্থী

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close