reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

মুক্তমত

নান্দনিক হোক পৃথিবী

মোহাম্মদ আবু নোমান

যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি না পেয়ে লাখ লাখ বেকারের রাতের ঘুম হারাম হয়ে রয়েছে পরিবারের ভরণ-পোষণের চিন্তায়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো রেজাল্ট করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার পরও বয়সের অজুহাতে যখন কেউ চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন না, তখন এ সুন্দর পৃথিবীটা তার জন্য কবর ও নিজেকে জিন্দা লাশ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫৭ হাজারের বেশি শিক্ষক শূন্যপদ রয়েছে। এনটিআরসিএ প্রতি বছর পরীক্ষা নিয়েও নিয়োগের বেলায় বিভিন্ন টালবাহানা করায় লাখ লাখ নিবন্ধনধারী বেকার কষ্টে দিন পার করছেন। সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩৫ বছর করার দাবিতে কয়েক বছর ধরেই আন্দোলন করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। তবে শেষ পর্যন্ত তা সরকারের সাড়া পায়নি। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গত ২৫ মার্চ যাদের বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে সম্প্রতি তাদেরও সরকারি চাকরিতে আবেদনের সুযোগ দিয়েছে সরকার।

করোনা দুর্যোগের মধ্যে চাকরিপ্রত্যাশীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বয়সে পাঁচ মাস ছাড়ের সরকারি সিদ্ধান্ত শুধু যৌক্তিকই নয়; আশাপ্রদও বটে। এর মাধ্যমে করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে প্রায় পাঁচ মাস সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না হওয়ায় ত্রিশোর্ধ্ব হাজারো চাকরিপ্রত্যাশীর বর্ধিত সময়ে চাকরির আবেদনের সুযোগই তৈরি হবে না; একই সঙ্গে তাদের পরিবারও উপকৃত হতে পারে। একই সঙ্গে সরকার ৫ মাস ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে যে সদিচ্ছা প্রদর্শন করেছে, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা যৌক্তিক ও স্থায়ীভাবে বাড়িয়ে সে পথ আরো প্রশস্ত করতে পারে। ২৫ মার্চের আগে যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ করেও তা প্রকাশ করতে পারেনি সেসব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে গত ২৫ মার্চ পর্যন্ত যাদের বয়স ৩০ পূর্ণ হয়েছে তাদেরও আবেদনের সুযোগ দিতে বলা হয়েছে।

অনেক পরিবার বসতভিটা বিক্রি করে ছেলে-মেয়েকে পড়ালেখা করিয়েছেন। এখন রাষ্ট্র বলে দিল তোমার বয়স ৩০, অতএব তুমি বাতিল! ডিগ্রির কোনো মূল্য নেই! ৩০ বছর হলে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা যাবে না, এটা অমানবিক নয় কি? তাহলে এসব বেকাররা কী করবে? কোথায় যাবে? তাদের বিকল্প কী? তারা কি রাষ্ট্রের নাগরিক নন? রাষ্ট্র তাদের কোনো দায়িত্ব নেবে না? চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে অবসরের বয়স কমিয়ে ৫৮ বছর করলে ক্ষতি কী? এতে দ্বিগুণ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। পাশাপাশি সরকারি কর্মকান্ডেও গতি বাড়বে। এমনতো নয় যে, দেশে ৫০ লাখ চাকরি আছে আর বেকার মাত্র ৩০ লাখ! একজন শিক্ষার্থী যে বয়সে পড়াশোনা শেষ করেন; এরপর সরকারি চাকরির বাজার বুঝতে বুঝতেই তার বয়স ৩০ বছর হয়ে যায়। সরকার যেমন করোনার প্রভাব বিবেচনায় বয়সে ছাড় দেওয়ার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তেমনি যৌক্তিকতার বিচারে স্থায়ীভাবে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে ভাবাও প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। এ দেশেও বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হলে কারো ক্ষতির আশঙ্কা তো নেই-ই বরং যারা সরকারি চাকরিতে নিজেদের মেধা প্রয়োগ করতে চান, তাদের বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি হবে।

বর্তমানে শিক্ষিত যুবকদের সংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় চাকরিপ্রার্থীরা কয়েকবার চেষ্টা করার সুযোগ প্রত্যাশা করেন। এরূপ সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারের কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়। পাঠাভ্যাসবিমুখতার এ সময়ে চাকরিপ্রার্থী যুবসম্প্রদায় কর্মসংস্থানের আশায় তাদের বাধ্যতামূলক এই জ্ঞানচর্চাকে উৎসাহিত করা ভালো দিক। অবসরের পর রাষ্ট্রদূত, আমলা, উপদেষ্টাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বয়সের বালাই নেই; কিন্তু যোগদানের বয়সে এত জটিলতার বিষয় আসে কেন? কেউ সারা জীবন চাকরি করবে, আর কেউ বেকার থাকবে! এক দেশে তো দুই আইন চলতে পারে না! চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দরকার নেই! আর যারা চাকরিতে আছেন, ওনাদের বেতন দফায় দফায় বাড়ানোই চলতে থাকুক! মানুষ বয়স হলে কাজের গতিও কমে যায়। চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়াতে জটিলতা থাকলে, পূর্ণ অবসরেরও একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমা কেন করা হয় না? বয়োজ্যেষ্ঠরা অবসরে গেলে অপেক্ষাকৃত তরুণ চাকরিজীবীদের পদপ্রাপ্তি তথা পদোন্নতির সুযোগ তৈরি হয়। বয়োজ্যেষ্ঠরা দীর্ঘদিন পদ ধরে রাখলে তরুণরা আরো বেশি সময় পদোন্নতিবঞ্চিত থাকবেন। যুবসম্প্রদায়ের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র ও সময় প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বা ৩৫ বছরে উন্নীত করা অযৌক্তিক নয়। অবসরের সময় বাড়লে সংগত কারণে চাকরিতে নতুনদের প্রবেশের সুযোগ কমে আসে। এজন্য বয়োজ্যেষ্ঠদের সেবা একটি যৌক্তিক বয়স পর্যন্ত পেতে এবং নতুন প্রজন্মের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৫৮ বছর করা যেতে পারে।

গত নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতাসীনরা বয়স বাড়ানোর বিষয়টি রেখেছিলেন। এখন নির্বাচন শেষ! সরকার আমলাতান্ত্রিক তন্ত্র-মন্ত্রের গোলকধাঁধায় ডুবে প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষিত বেকার ও কোটি শিক্ষার্থীর যৌক্তিক ও সময়ের জনপ্রিয় দাবিকে আমলে নিচ্ছে না। সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করার একটি বেসরকারি সিদ্ধান্তের প্রস্তাব ইতিপূর্বে প্রত্যাখ্যান করেছে জাতীয় সংসদ। গত ২৫ এপ্রিল ২০১৯, বগুড়া-৭ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রেজাউল করিম (বাবলু) ওই প্রস্তাবটি এনেছিলেন। কিন্তু ‘না’ বোধক কণ্ঠভোটেই তার প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়। প্রবাদ আছে ‘অভাগার দুচোখ যেদিকে যায়, সাগর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায়!’ লাখ লাখ তরুণ এবং যুবকের ভবিষ্যৎ একটি (পরিকল্পিত!) ‘না’ বোধক ধ্বনিতেই নিঃশেষ করে দেওয়া হলো! রেজাউল করিম তার বক্তব্যে বলেছিলেন, বিশ্বের ১৯২ দেশের মধ্যে ১৫৫টি দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৫৫ বছর, কোথাও কোথাও ৫৯ বছর পর্যন্ত। দেশে এখন শিক্ষিত বেকার ২৮ লাখের বেশি। শিক্ষিত বেকার পরিবারের জন্য বোঝা। শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করেছিল। এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করছে। চাকরি না পেয়ে অনেক যুবক মাদক, ছিনতাই ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করা যুক্তিযুক্ত হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : সংবাদকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close