মো. এমদাদ উল্যাহ

  ১৮ আগস্ট, ২০১৯

মুক্তমত

চামড়ার দরপতন এবং কিছু কথা

কাঁচামালের সহজ লভ্যতার পাশাপাশি মূল্য সংযোজনের হিসেবে সবচেয়ে বেশি রফতানি আয়ের অন্যতম বড় উৎস চামড়াশিল্প। এ কথা শুধু কাগজে-কলমেই। স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে হঠাৎ দরপতন হয়েছে এ শিল্পের। কোরবানির চামড়ার দাম কমিয়ে সিন্ডিকেটের কোন উদ্দেশ্য এখন পর্যন্ত তা বের করা সম্ভব হয়নি। এতিমের হক হিসেবে খ্যাত কোরবানির চামড়ার দরপতনে কপাল পুড়েছে এতিম ও মৌসুমি ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের। অনেক স্থানে এতিমখানা ও মসজিদে দানের চামড়াও বিক্রি হয়নি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায় একত্রে ৯০০ চামড়া পুঁতে ফেলা হয়।

ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকার ও ব্যবসায়ীরা মিলে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েনেছ। এ বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৪৫-৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকা। গত বছর প্রতি বর্গফুটের দাম একই ছিল। ২০১৭ সালে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ঢাকায় ৪৫-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০-৪৫ টাকা। এ ছাড়া সারা দেশে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকায় সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে ব্যবসায়ীদের। কিন্তু একটি গরুর চামড়া ৪৫-১০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে কোরবানিদাতাদের। অবস্থা এমন যে, কে শোনে কার কথা!

চামড়ার এমন দরপতনের বিষয়ে একে অপরকে দোষারোপ করেন। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা দোষারোপ করছেন পাইকারি ক্রেতাদের, পাইকারি ক্রেতারা বলছেন আড়তদাররা কম দামে চামড়া ক্রয় করছেন। আড়তদার বলছেন ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমাদের বকেয়া পরিশোধ করেনি। যার ফলে অর্থ সংকটে চামড়া ক্রয় করতে পারছেন না। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বলছেন সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমানো হয়েছে। তার পরও প্রতিযোগিতা করে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। প্রতি চামড়ায় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনেছেন। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রিতে একটি চেইন আছে। ট্যানারির মালিকরা দাম কম দিলে অন্যরাও কম দিতে বাধ্য হন। তবে ট্যানারি মালিকরা বিশ্ববাজারে ভালো দামে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করলেও আড়তদার, চামড়া সংগ্রহকারীদের সে সুযোগ থাকে না।

সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে এ শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি পণ্য হওয়া সত্ত্বেও সিন্ডিকেটের কারসাজিতে শিল্পটি বিপন্ন হতে চলেছে। তৃণমূল পর্যায়ে বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার পেছনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সঙ্গে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। এ দুইয়ের কারসাজিতে চামড়াশিল্প আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। যেমন প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত ২২ কোটি ঘনফুট চামড়ার প্রায় অর্ধেকই ব্যবহৃত হচ্ছে না রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনে। চামড়ার আন্তর্জাতিক ক্রেতাজোট লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের ছাড়পত্র না থাকাই এর মূল কারণ। কিন্তু প্রতি মাসেই নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রায় ৫০ লাখ বর্গফুট চামড়া আমদানি করছে। গত ৪-৫ বছরে চামড়া এবং চামড়াজাত সব পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু চামড়ার দাম কমেছে অর্ধেক। কাঁচা চামড়ার দাম কমছে, চামড়াজাত পণ্যের দাম বাড়ছে কেন?Ñ এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য গার্মেন্টসের পরই এখন চামড়াশিল্পের অবস্থান। জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, রাশিয়া, ব্রাজিল, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়। চামড়াজাত পণ্যের প্রধান ক্রেতাদের অন্যতম চীন। এবারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। চীন কম দামে পণ্য কেনার আলটিমেটাম দিয়েছে। ফলে কোনোভাবেই নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কাঁচা চামড়া কেনা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয় ১১৩ কোটি ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬ কোটি ডলারে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ আয়ের পরিমাণ আরো বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি আয় অস্বাভাবিক কমে ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ওই অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ১০১ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ ক্ষেত্রে আয় কম হয়েছে ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চামড়া খাত থেকে ৮৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। যদিও এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এ হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ এবং আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ আয় কমেছে।

খবরে প্রকাশ, চামড়াশিল্পে সংকটের নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। কারণগুলো হচ্ছেÑ সঠিক পরিকল্পনার অভাব। চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়া। চামড়াশিল্পকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে না তোলা। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কারখানার পরিবেশ উন্নত না করা। চাহিদার তুলনায় ব্যাংকঋণ না পাওয়া। পুঁজি সংকট। দক্ষ শ্রমিকের সংকট। গতবারের চামড়া এখনো প্রক্রিয়াজাত করতে না পারা। আগের বছরের সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার গুণগত মান কমে যাওয়া। জমির দলিল হস্তান্তরসহ নানা বিষয় নিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব।

ট্যানারি মালিকরা জানান, টেকসই পরিবেশ অনুশীলনের নির্দেশনা বজায় রাখার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ চামড়া শিল্পনগরীতে প্রতিটি কারখানায় নিজস্ব ইটিপি স্থাপনসহ বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে যথাযথ মূল্য পাচ্ছেন না এখানকার উদ্যোক্তারা। ফলে চাহিদাও কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়। এমন পরিস্থিতিতে কাঁচা চামড়া রফতানির বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত এ শিল্পের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close