রেজাউল করিম খান

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

নির্বাচনের রাজনীতি

বছরের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গন সরব হয়ে উঠেছে। তবে তা আলোচনা অনুষ্ঠান, টকশো, বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। দেশের প্রধান দুই বড় রাজনৈতিক জোটের মধ্যে চলছে বাকবিত-া। চলছে নিঃস্ফল গলাবাজির প্রতিযোগিতা। অনেকে বলছেন, দুই জোটের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রয়েছে মুখোমুখি অবস্থানে। কিন্তু আসলে তা নয়। আওয়ামী লীগের আছে সরকার আর সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন ও বাহিনী। আছে অর্থ ও পেশিশক্তি। এইসব ব্যবহারের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি জোটকে রাজপথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জামায়াতের এখন প্রকাশ্য কমকা- নেই। জোটের অন্য শরিকরা মুকুটের এক একটি পালক মাত্র। বৈঠকে শোভাবধন ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। বিএনপি আছে সেমিনারে, সংবাদ সম্মেলনে। দলের প্রথম সারির নেতারা সেসব অনুষ্ঠানে আসছেন, বক্তব্য রাখছেন। সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন। ১৪ সাল থেকেই বলে আসছেন, এই সরকার অনির্বাচিত, অবৈধ। আবার এই সরকারের কাছেই দাবি জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। দাবি প্রধানত একটিই। তা হচ্ছে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন। বিএনপি নেতারা কথায় কথায় কান্নার সুরে বিগত নির্বাচনের স্মৃতিচারণা করেন। কেউ কেউ বলেন, ওই নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। তার চেয়েও বড় ভুল ছিল নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা। তবে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ভুল স্বীকার করেননি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দুই বড় রাজনৈতিক জোটের কাছেই স্মরণীয় একটি দিন। ওইদিন নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে ও প্রতিহতের ডাক দেয়। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই নির্বাচন বর্জন করে। এতদসত্ত্বেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়ে আওয়ামী লীগ তার শরিকদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে। যদিও এ ব্যাপারে দেশ-বিদেশে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে। সেই থেকে আওয়ামী লীগ প্রতি বছর ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ বা ‘গণতন্ত্র মুক্ত দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এবার হয়েছে গণতন্ত্রের বিজয় দিবসের উল্লাস। যতটা না দলীয় ব্যবস্থাপনায় তার চেয়ে বেশি ছিল সরকারি উদ্যোগে। রাজধানীসহ সারা দেশের প্রধান প্রধান দশনীয় স্থান ও ভবনসমূহ সাজানো হয়েছিল রঙিন আলো দিয়ে। আয়োজন করা হয়েছিল উন্নয়ন মেলার।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতার চেয়ে লোভনীয় আর কিছু হয় ন। এই ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা ও পুঁজির নিয়ন্ত্রণ সংরক্ষিত থাকে ব্যক্তির হাতে। উৎপাদন হয় কেবল মুনাফার জন্যই। এখানে শ্রমিকও পণ্য হিসেবে গণ্য হয়। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পুঁজির মালিকরা বুর্জোয়া, তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও উদারপন্থি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের ভেতর প্রভাব বিস্তার করে। এসব দলের মধ্যে নীতিনৈতিকতার বড়ই অভাব। গণতন্ত্রের বালাই নেই। তারা যখন রাষ্ট্রক্ষমতা পায়, তখন অন্যায়-অনিয়ম আর দুর্নীতি চলে অবাধে। শাসকদল ভুলে যায় সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকারের কথা। তারা মনে করে, এরপর আর তাদের প্রয়োজনই হবে না। অর্থাৎ ভোটের জন্য জনগণের কাছে যেতে হবে না। রাষ্ট্র নিয়োজিত বাহিনীই তাদের রক্ষা করবে। স্বৈরশাসকরা এমন আচরণ করতেই পারে। কিন্তু নব্বুই সালের পর গণতন্ত্রের লেবাসে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তারাও স্বৈরশাসকের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয়েছেন। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার পরিবর্তে লুট হয়, মানবাধিার লঙ্ঘিত হয়, গণতন্ত্র বিপন্ন হয়। লোভ আর ক্ষমতার মোহে শাসকরা অন্ধ হয়ে যান।

গণতন্ত্রের একটি শর্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান। সেই নির্বাচন কেমন হবে তা নির্ধারণ করে সংবিধান। জাতীয় সংসদ সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানকে একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। ওইসব পরিবর্তন যতটা না দেশ ও জনগণের জন্য, তার চেয়ে বেশি হয়েছে দল ও গোষ্ঠীর জন্য। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনের কথা কেউ অস্বীকার করবেন না। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় বসে বারবারই এর অসারতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। ক্ষমতার বাইরে থাকা দলকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করতে হয়েছে। সেই আন্দোলন সহিংস রূপ নিয়েছে। নির্বাচন বর্জনও হয়েছে একাধিকবার। বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে দশবার। এর মধ্যে দুটি সংসদ মেয়াদ পূর্তির আগেই ভেঙে দেয় সামরিক বাহিনী। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। সংসদ টিকে ছিল এক বছর। ১৯৮৮ সালে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচন বর্জন করে। দুই বছরের মধ্যে ওই সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তৈরি সংসদ বেঁচে ছিল পরের মাস অবধি। এই পরিসংখ্যান বলছে, প্রধান কোনো রাজনৈতিক জোট বা দল সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে সেই সংসদ বেশিদিন টেকে না। বিএনপি ও তাদের জোট নিকট অতীতের এই বিষয়টিকে সম্ভবত প্রধান হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নির্বাচন প্রতিহতেরও ডাক দেওয়া হয়। বিএনপির ধারণা হয়েছিল, নির্বাচন বাতিল হয়ে যাবে বা অল্প কিছুদিনের মধ্যে পুনরায় তফসিল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু বিএনপির সে আশার গুড়ে বালি পড়ে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, আগের নির্বাচনগুলো বর্জনের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দল রাজপথে আন্দোলনে নামে। মূলত আন্দোলনের তীব্রতার কারণেই সরকার তত্ত্বাবধায়ক সকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ২০১৪ সালে তেমনটি হয়নি অথবা সরকার ‘কঠোর হস্তে’ আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হয়েছে।

বছর শেষে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন। ওই নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো উজ্জীবিত হয়ে উঠছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতি আসনে তাদের প্রার্থী একাধিক। সেই কারণে অভ্যন্তরীণ বিরোধও বেশি। বিরোধ নিরসনে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। কেন্দ্রীয় নেতারা জেলায় জেলায় সাংগঠনিক সফর শুরু করেছেন। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে টাকা খরচের প্রতিযোগিতা। কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, কর্মিসভায় শোডাউন করে কোনো লাভ হবে না মনোনয়নপ্রত্যাশীদের। চূড়ান্ত বিচারে মনোনয়ন দেবেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার কাছে সবারই তথ্য আছে। এখন নেতাকর্মীদের যেতে হবে জনগণের কাছে। দলের জন্য, নৌকার জন্য ভোট চাইতে হবে। তুলে ধরতে হবে সরকারের সাফল্যের কথা। বলতে হবে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আর ধ্বংসাত্মক রাজনীতির কথা।

এদিকে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান নয়। তবে ভেতরে ভেতরে চলছে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ। প্রার্থীরাও ঘরে বসে নেই। কিন্তু তাদের সামনে সমস্যা অনেক। প্রায় প্রত্যেকের নামেই মামলা আছে। অনেকেই এলাকায় থাকতে পারেন না। কেউ কেউ এখনো কারাগারে আছেন। এর চেয়েও বড় সংকট সামনে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। বিএনপি নেতাকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, রায়ে তাকে সাজা দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে দলের করণীয় কী হবে, কে বা কারা নেতৃত্ব দেবেন, আন্দোলন না আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে তা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে ও বাইরে আলোচনা চলছে। বেগম জিয়াও সবার সঙ্গে বসছেন, বৈঠক করছেন। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। এ কথা স্বীকার করতে হবে যে এই মুহূর্তে বিএনপির আন্দোলনের সক্ষমতা নেই অথবা প্রথম সারির নেতারা আন্দোলনে নামতে ভয় পান। তাদের আছে মামলা-হামলা, হাজতবাস ও সম্পদ হারনোর ভয়। সে ক্ষেত্রে বেগম জিয়ার মামলার বিষয়টি আইনজীবীদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতিকেই প্রধান করণীয় হিসেবে গ্রহণ করা সংগত হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist